মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদীর হত্যা, লুটপাট, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, জোর করে ধর্মান্তকরণের অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে আদালতে।
Published : 17 Aug 2023, 05:34 PM
যুদ্ধাপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে পদ হারালেন ছাত্রলীগের আরও ২৫ নেতা। এর মধ্যে ১৯ জন জামালপুরের, ৬ জন নরসিংদীর।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জামালপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাফিউল করীম ও নরসিংদী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল আহমেদ শাওন এসব তথ্য জানান।
পদ হারানো নেতারা ছাত্রলীগের উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের পাশাপাশি কলেজ ইউনিটে ছিলেন।
জামালপুরে অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের মধ্যে আছেন ইসলামপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান, মেলান্দহ পৌর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসিফ আহামেদ, মেলান্দহ সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান সেতু ও মেলান্দহ উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য আশরাফুল সালেহীন রিয়াদ।
অব্যাহতি পাওয়া সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নানা বাড়ির এক আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার ফেইসবুক আইডিতে শুধু ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ লিখেছি। তবে এর কিছুক্ষণ পর যুদ্ধাপরাধী সাইদীর মৃত্যুর খবর পাই। লেখাটি এখনো আমার আইডিতে আছে।”
জীবনের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত; ভবিষ্যতেও এই দলের কর্মী হিসেবে কাজ করবেন বলে জানান তিনি।
ছাত্রলীগের জামালপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নাফিউল করীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদেরকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে সুপারিশ করা হচ্ছে।
নরসিংদীতে যাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তারা হলেন, মাধবদী থানার ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুজন ভুঁইয়া, পলাশ উপজেলা শাখার সহসভাপতি মো. নাদিম মিয়া, একই উপজেলার জিনারদী ইউনিয়নের সহসভাপতি হাফিজুর রহমান অপু, মনোহরদী উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের যুগ্ম আহ্বায়ক জে এস জুনায়েদ, বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের যুগ্ম আহ্বায়ক সাকিব আহমেদ এবং মাধবদী উপজেলার পাইকারচর ইউনিয়নের সহসভাপতি শরিফুল ইসলাম শরিফ।
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল আহমেদ শাওন বিডিনিউজকে বলেন, “যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে নিয়ে ফেইসবুকে তারা যেসব কথা লিখেছেন, তা ছাত্রলীগের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থি। একজন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে তারা এভাবে কথা বলতে পারেন না। এ কারণে তাদেরকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে কেন্দ্রকে সুপারিশ করা হয়েছে।”
১৯৭১ সালে পিরোজপুরের পারেরহাটে নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত সাঈদী মারা যান গত ১৪ অগাস্ট।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের এই দোসরের মৃত্যুতে তার দল জামায়াত ও ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীরা তাৎক্ষণিক শোক জানাতে থাকেন।
ছাত্রলীগের পদধারী বহু নেতাও শোক প্রকাশ করলে সংগঠনের মধ্যেই প্রশ্ন উঠে।
সমালোচনার মুখে বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাত্রলীগ জেলা কমিটির ছয় জনকে সাময়িক বহিষ্কারের কথা জানায়। এরপর অব্যাহতি দেওয়া হয় চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের তিনজনকে।
সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জেলা কমিটি কেবল সাময়িক বহিষ্কার করতে পারে। চূড়ান্ত বহিষ্কারের ক্ষমতা কেবল কেন্দ্রীয় কমিটির।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোডর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ন্যূনতম সহানুভূতি ও সাফাই গাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে কেউ এই ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। পাশাপাশি সব সাংগঠনিক ইউনিটের নেতাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।”
সাঈদীর অপরাধ আদালতে প্রমাণিত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিচার মোট ২০টি অপরাধে তার বিচার শুরু হয়। এর মধ্যে আটটি অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ার পর ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
তার বিচার শুরু হয়েছিল ২০টি অভিযোগে। এর মধ্যে আটটি আদালতে প্রমাণ হয় সন্দেহাতীতভাবে।
এর মধ্যে ছিল হত্যা, লুটপাট, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, জোর করে ধর্মান্তকরণ।
রায় ঘোষণা করে বিচারপতি আনোয়ারুল হক বলেন, “ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সফলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাঈদী পিরোজপুরে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন।”
আসামির পরিচয় দেওয়ার পর বিচারক বলেন, “আজ এখানে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার রায় হচ্ছে না। দুই বারের সংসদ সদস্য বা জামায়াতের নেতা সাঈদীরও রায় দিচ্ছে না ট্রাইব্যুনাল।
“আজ যার রায় বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হচ্ছে, তাকে জানতে হলে আমাদের চল্লিশ বছর পেছনে তাকাতে হবে। তখন পিরোজপুরে সাঈদীকে মানুষ চিনত দেলু নামে।”
আদালতের সিদ্ধান্ত হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ৩০ বছরের যুবক সাঈদী ছিলেন রাজাকার বাহিনীর একজন সদস্য। উর্দু ভালো বলতে পারতেন বলে পাকিস্তানি সেনাদের সব অপারেশনেই তিনি তাদের সঙ্গে ছিলেন।
সাঈদী এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সাজা পাল্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষণা করে।
হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার বিষয়টি আপিল বিভাগেও প্রমাণ হয়েছে বলে জানানো হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ২০১৭ সালের ১৫ মে তা খারিজ করে দেয় আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় চূড়ান্ত করে সর্বোচ্চ আদালত।
মুক্তিযুদ্ধের চার বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তন শেষে সাঈদী দেশজুড়ে পরিচিত হয়ে উঠেন ওয়াজের বক্তা হিসেবে। তার ৭১ সালের ভূমিকা অস্বীকার করতে থাকেন। পরে তিনি ধীরে ধীরে জামায়াতের নায়েবে আমিরের পদ পেয়ে যান।
১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পিরোজপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি।