আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া ৭৬ বছর বয়সী এ আলোকচিত্রী এক আড্ডা অনুষ্ঠানে তার অভিজ্ঞতার কথা জানান।
Published : 27 Nov 2022, 10:44 AM
কলকাতার আলোকচিত্রী মালা মুখার্জি ষাটের দশকে কিশোর বয়সে অসংখ্য ছবি তুলেছেন ‘লাইকা’ ক্যামেরায়। তারপর কয়েক দশক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরেছেন; ধারন করেছেন অসংখ্য ছবি।
ক্যামেরায় ছবি বন্দি করলেও নিজের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে তিনি বন্দি করেননি কখনোই।
ছবি তোলার শখ পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে; সে সুবাদে শিশু বয়সেই বিদেশী ‘নামী ব্র্যান্ডের’ ক্যামেরায় ছবি তোলার সুযোগ হয়। হাতেখড়ির ‘মামিয়া সিক্স’ ফিল্ম ক্যামেরা বাবা জাপান থেকে এনেছিলেন। ‘লাইকা’ ক্যামেরাটি তার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এক মার্কিন সৈনিকের কাছ থেকে ৪০ টাকায় কিনেছিলেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া ৭৬ বছর বয়সী এ আলোকচিত্রী শনিবার নারায়ণগঞ্জ শহরের আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে এক আড্ডা অনুষ্ঠানে তার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খোলেন।
নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক ক্লাবের (এনপিসি) আয়োজনে এ আড্ডার শুরুতে এনপিসির যুগ্ম সম্পাদক মুনতাসির মঈন আলোকচিত্রী মালা মুখার্জি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। অনুষ্ঠানে এনপিসি’র সদস্যরাও অংশ নেন।
মুনতাসির মঈন বলেন, ষাটের দশকের আনকোড়া আলোকচিত্রী থেকে পেশাদার হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছেন মালা মুখার্জি। ১৯৮৬ সালে সকলে তাকে পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে পাওয়া যায়। তখন থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, জার্নাল ও বুক কভারে তার ছবি প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৯৩ সালে লন্ডনের গিল্ড হল ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাপ্লায়েড আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন স্টাডিজে গ্রাজুয়েশন করেন তিনি।
আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত এই আলোকচিত্রী বিভিন্ন সময় দেশ-বিদেশে সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি এককভাবে ৪৫টি এবং দলীয়ভাবে ৬৫টি প্রদর্শনী করেছেন। ২০০২ সালে বিখ্যাত পাবলিকেশন ‘ফাইডন’ তাকে বিশ্বের ১০০ জন ‘কনটেম্পরারি ফটোগ্রাফার’ এর তালিকায় স্থান দেয়।
গল্পের শুরুতেই মালা মুখার্জি জানান, তার পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায়।
এরপর ধীরে ধীরে জীবনের ফেলে আসা অধ্যায়গুলোর পাতা উল্টে বলেন, “লাইকা ক্যামেরা নিয়ে শিলং গিয়েছিলাম। ফিল্ম ভরে ছবিও তুললাম। ফিরে ছবিগুলো বের করার সময় জানতে পারলাম, ফিল্মটাই ঠিকমতো লাগানো হয়নি।”
হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “ওইটা ছিল লাইকা ক্যামেরার প্রথম ব্যবহার। নিজে ভুল করার পর সবসময় অন্যদের বলেছি, ফিল্ম ঠিকমতো আছে কিনা সেটা দেখে নিও।”
নিজেকে ‘স্বাধীনচেতা’ অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “আমি খুবই সাধারণ লোক, সাধারণভাবেই ছবি তুলি। পুরোপুরি নিজের আনন্দে ছবি তুলি। আমি বিখ্যাত অনেকের অ্যাসাইনমেন্টও করেছি।
“কিন্তু, যেখানে স্বাধীনতা পেয়েছি সেখানেই কাজ করেছি, মহাআনন্দে ছবি তুলেছি।”
দীর্ঘ সময়ে অনেক কাজ করলেও বিজ্ঞাপনে কাজ করেননি বলে জানান পেশাদার এই আলোকচিত্রী।
“ আমি বিজ্ঞাপনের ছবি কখনও তুলিনি। বিজ্ঞাপনের ছবিতে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়। আমি অত পরীক্ষা দিতে পারি না। ছোটবেলা থেকেই পরীক্ষা দিতে আমি ভালোবাসি না।” যোগ করেন তিনি।
প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছাড়াই দীর্ঘদিন ছবি তুলেছেন বলে জানান মালা মুখার্জি। ‘একটি ছাগলের উঁচু হয়ে পাতা খাওয়ার মুহূর্ত ধারনই ছিল তার প্রথম কাজ।’
সেসব দিনের কথায় কন্ঠে রসিকতা ওঠে, মুখে একরাশ আনন্দ ভাসিয়ে তিনি বলেন, “আমার পরিবারের লোকজনই গিনিপিগ হতো। তাদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে ছবি তুলতাম। ফটোগ্রাফিতে আলাদা একাডেমিক শিক্ষা না থাকার কারণে ছোটবেলা থেকেই একটা স্বাতন্ত্র্যতা ছিল।
“আজও যেখানে যা ভালো লাগে তাই দেখে মনের আনন্দে ছবি তুলি। মন খারাপের সময়ও ছবি তুলি।”
অনেক প্রাপ্তির মধ্যে হতাশার গল্পও শোনালেন তিনি। একাধিকবার না জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছবি ব্যবহার করার খবরে হতাশ হয়েছেন। ‘কপিরাইট আইন’ নিয়ে আলোকচিত্রীদের সচেতন থাকার পরামর্শও দেন তিনি।
লন্ডনে থাকাকালীন অভিজ্ঞতার কথাও জানান মালা মুখার্জি। বাংলাদেশ ও কলকাতার চেয়েও বড় ইলিশ সেখানে খেয়েছেন, বলেন তিনি।
পাঠাগারের পঞ্চম তলার ‘পরীক্ষণ হলে’ চলছিল এই আড্ডা। কথার ফাঁকে ফাঁকে মালা মুখার্জির তোলা কিছু আলোকচিত্র প্রদর্শন হচ্ছিলো পর্দায়। সেসব ছবির প্রেক্ষাপটও বর্ণনা করছিলেন তিনি। অধিকাংশ আলোকচিত্রই পুরোনো ভবন ও দেয়ালের।
এই ‘সাবজেক্টের’ প্রতি অনুরাগের কথাও অকপটে স্বীকার করলেন তিনি। আড্ডায় আলোকচিত্র নিয়ে দু’একজনের প্রশ্নের উত্তরও দেন।
আড্ডার শেষদিকে তিনি বলেন, “হাজার হাজার ছবি তুলেছি। এখন বুড়ো হয়ে গেছি তো। তারপরও ছবি তুলে যেতে চাই। যেখানে আগে ছবি তুলেছি, সেখানে আবারও যাই। আগের মতো পাই কিনা খুঁজি। কিন্তু কিছুই আর আগের মতো থাকে না। কেউই থাকে না।”
আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে আলোকচিত্রের উপর ‘ফটোগ্রাফিক বুক শো’ চলে। এতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আলোকচিত্রীর দুর্লভ সব বই প্রদর্শন করা হয়। এই ধরনের ‘বুক শো’ নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে বলে দাবি আয়োজক সংগঠনের সভাপতি জয় কে রায় চৌধুরীর।
জয় বলেন, “নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফি ক্লাব প্রায়ই দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রীদের আমন্ত্রণ জানায়। তাদের গল্প শুনতে আড্ডার আয়োজন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এবার কলকাতার বিখ্যাত আলোকচিত্রী মালা মুখার্জিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।”