“আসার পরদিন খবর পেলাম বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমার করার কিছু নেই। কারণ আমার ট্রাকে থাকা পণ্য খালাস হয়নি।”
Published : 19 Jun 2024, 09:53 AM
হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসেন তারা। বাড়িঘর-পরিবার থাকলেও উৎসব কিংবা বেদনায় তাদের পাশে থাকার সুযোগ হয় না। রুটি-রুজির সন্ধানে বের হয়ে নিজেদের বাহনটিই হয়ে ওঠে তাদের সংসার-পরিবার।
একে নিজেদের নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে বাংলাদেশের বেনাপোল বন্দরে আসা ট্রাকের চালক ও তাদের সহকারীরা।
দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলে প্রতিদিনই প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে চারশ থেকে পাঁচশ ট্রাকে নানা ধরনের পণ্য আসে। এসব ট্রাকে থাকে কাঁচামাল থেকে শুরু করে খাদ্য ও প্রসাধনী সামগ্রীসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।
ট্রাকগুলো নিয়ে চালকরা আসেন ভারতের দিল্লী, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, নাগাল্যান্ড, হরিয়ানা, জামশেদপুর, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, পশ্চিমবাংলাসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে।
রপ্তানিকৃত পণ্যের চালান নিয়ে তারা বেনাপোল বন্দরে ঢোকার পর পণ্য খালাস করতে যতদিন সময়ই লাগুক না তাদের পক্ষে আর বাড়ি ফেরার সুযোগ থাকে না।
সম্প্রতি ভারত থেকে আসা এসব ট্রাক চালকরা বেনাপোল বন্দরে পণ্য নিয়ে আসার পর তাদের নানা কষ্টের কথা জানান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
প্রায় এক মাস আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন বিহারের বাসিন্দা জিতেন্দ্র কুমার যাদব (৪০)।
এই ট্রাক চালক বলেন, “দু'দিন হল আমি বাংলাদেশের বেনাপোল বন্দরে পণ্য নিয়ে এসেছি। আসার পরদিন খবর পেলাম বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমার করার কিছু নেই। কারণ আমার ট্রাকে থাকা পণ্য খালাস হয়নি। আর খালাস হলেও আমার বিহার পৌঁছাতে সময় লাগবে বেশ কদিন।”
যাদব বলেন, সংসারে বাবা-মায়ের পাশাপাশি স্ত্রী ও তিনটি বাচ্চা আছে। দুই বছরের ছোট বাচ্চা আনিসকা কুমারির কথা সবসময় মনে পড়ে।
রাজস্থানের আলোয়ার থেকে আসা ট্রাকচালক আকবর আলি তার দুর্বিষহ জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেন, “মা-বাবা পরিবার-পরিজন রেখে বেশিরভাগ সময়ই বাইরে কাটে। এতে হঠাৎ করে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমরা পাশে থেকে তাদের সেবা করতে পারি না।
“পরিবারের কোনো আনন্দ-উৎসবের মুহূর্তেও আমরা তাদের সঙ্গে শামিল হতে পারি না। এতে করে আমরা যেমন কষ্ট পাই। তেমনি করে আমাদের পরিবারও কষ্ট পায়।”
রাজস্থান থেকে রাসায়নিক বোঝাই লরি নিয়ে বেনাপোল আসা এই ট্রাকচালক বলেন, “এবার ঈদ বাড়িতে করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু বেনাপোলে লরি খালি করতে পারলাম না। বাবা-মায়ের পাশাপাশি দুই বছরের ছোট মেয়ে আলপিজার কথা বারবার মনে পড়ছে।”
ভারতের উত্তরপ্রদেশ থেকে মেশিনারি পণ্যের চালান নিয়ে এসেছেন ট্রাক চালক শাহবাজ আজম খান।
তিনি বলেন, “আমি মহারাষ্ট্র নাগপুর থেকে ছত্রিশগড়, রাজস্থান, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবাংলা হয়ে বেনাপোল বন্দরে এসেছি চার দিন হল। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসে এখনও আমার ট্রাকে থাকা পণ্য খালাস করাতে পারলাম না।”
“আমার মতো অনেক ট্রাক চালক পণ্য খালাসের জন্য সিরিয়ালে আছেন। তাদের কারো ঈদ পরিবারের সঙ্গে করা হয়নি। এটা আমাদের নিয়তি, তাই মেনে নিতেই হয়।”
এ ভাবেই তাদের কেটে যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তবে নিজ দেশ থেকে ভিন দেশে আসার পর তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে তখন যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
ভারতের দিল্লির টেংরা এলাকার শফিকুল ইসলাম পেপার রোল নিয়ে বন্দরে ঢুকেছেন। পাঁচ দিন ধরে বেনাপোলে আটকে থেকে মনটা বেজায় খারাপ তার।
শফিকুল বলেন, “বাড়িতে জমজ মেয়ে আছে। প্রায়ই তাদের সঙ্গে কথা হয়। ওরা ঈদের আগের দিন বাড়ি যেতে বলেছে কিন্তু ওরা তো বোঝে না আমি সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভিন দেশে আছি।”
ভারতের উত্তর প্রদেশের ট্রাকচালক চন্দ্র লাল সিংহ বলেন, “রোদ, বৃষ্টি ও দাবদাহের মাঝেও আমাদের ট্রাকের ভিতরেই দিন কাটাতে হয়। ট্রাকের ভেতরেই রান্না করে খেতে হয়। দীর্ঘদিন আটকে থাকার কারণে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও তেমন একটা হয়ে ওঠে না। এসব নিয়ে আমরা খুব কষ্টের মধ্যে দিন কাটাই।”
এই ট্রাক চালকরা জানান, তারা নিজেদের রান্না নিজেরাই করে থাকেন। প্রতিটি ট্রাকে থাকে রান্নার সরঞ্জাম। যখন বিশ্রামের প্রয়োজন তখনই ট্রাক রেখে নাওয়া-খাওয়ার আয়োজন করেন।
বেনাপোলে আটকে থাকার সময় বন্দরের নির্ধারিত সীমার বাইরে যাওয়ার অনুমতি না থাকায় তারা প্রয়োজনীয় পণ্য ভারত থেকেই সংগ্রহ করে নেন।
উত্তর প্রদেশের কৌশ্বামী থানার বিধানপুর এলাকার ট্রাক চালক শিব নরেশ যাদব বলেন, “চেন্নাই থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেনাপোল এসেছি। গুদামে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় পণ্য খালাস করতে পারিনি।
“যে কারণে আমাদের প্রতি মুহূর্ত ট্রাকের ভিতরেই কাটাতে হচ্ছে। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আমরা প্রায় প্রতিদিনই গেইট পাস দেখিয়ে ওপার থেকে নিয়ে আসি। নিজেরা রান্নাবান্না করে খাই।”
বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) রেজাউল করিম জানান, বন্দরে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার কারণে অনেক সময় পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়। তবে ভারত থেকে আসা ট্রাক চালক ও তাদের সহকারীর থাকা এবং খাওয়ার জন্য সেখানে ক্যান্টিন আছে। কিন্তু ভারতীয় ট্রাক চালকরা সেগুলো ব্যবহার না করে নিজেদের মতো নিজেরাই রান্নাবান্না করে খান। তারা ট্রাকের মধ্যেই ঘুমান।