শুক্রবারের সহিংসতার পর দুইদিন পেরিয়ে গেলেও শহরে স্বাভাবিক হয়নি যানচলাচল।
Published : 22 Sep 2024, 08:51 PM
প্রায় নিস্তব্ধ শহর রাঙামাটি, দৃশ্যত প্রাণহীন। শুক্রবারের সহিংসতার পর দুইদিন পেরিয়ে গেলেও শহরে স্বাভাবিক হয়নি যানচলাচল। খোলেনি দোকানপাট, মার্কেট। খোলা থাকলেও স্কুল-কলেজে নেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি।
পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের ৭২ ঘণ্টার অবরোধ, পরিবহন শ্রমিকদের ‘অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট’ অব্যাহত রয়েছে। তবে শুক্রবার দুপুরে জারি হওয়া ১৪৪ ধারা ৪৬ ঘণ্টা পর রোববার দুপুর ১১টায় প্রত্যাহার করে নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
শুক্রবারের তাণ্ডবে তছনছ বনরূপার কাঁচাবাজারে একান্ত বাধ্য হয়ে আসা ক্রেতাদের উপস্থিতির কারণে কিছু মানুষের ভীড় চোখে পড়লেও সড়কে গণপরিবহন না থাকায়, স্তব্ধই বলা যায় পুরো শহরকে। শহরের একমাত্র গণপরিবহন অটোরিকশা বন্ধ, বন্ধ ব্যক্তিগত যানচলাচলও। ফলে মোটরসাইকেলে করে বা হেঁটেই অফিসে যেতে দেখা গেছে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ঠিক সময়ে হেঁটে পৌঁছালেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি না থাকায় তাদের অলস সময় কেটেছে গল্পে-আড্ডায়। অফিসগুলোর চিত্রও ছিলো প্রায় একইরকম।
রাঙামাটি পৌরসভার জন্মনিবন্ধন শাখার দায়িত্বে থাকা ফিরোজ আল মাহমুদ সোহেল বলেন, “এমনিতে প্রতিদিন আমাদের ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। চলমান সংকটের কারণে এবং গাড়ি চলাচল না করায় মানুষজন একেবারেই নেই।”
নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে পুরো শহরকে। শহরের মোড়ে মোড়ে দেখা গেছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের।
সকাল ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক মোশাররফ হোসেন খান ও পুলিশ সুপার ফরহাদ হোসেন শুক্রবারের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছেন। বিকাল ৩টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক সম্প্রীতি সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে সংঘাত রোধ করে সম্প্রীতি রক্ষায় নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগ।
রাঙামাটি শহরবাসীকে কোনো গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন রাঙামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম শাকিল।
শহরে পর্যাপ্ত সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ ম্যাজিস্ট্রেটরা টহলে আছেন। কোথাও কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। গুজবে আতঙ্কিত না হয়ে, পরিস্থিতি উত্তরণে প্রশাসনকে সহযোগিতার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপির দুই নেতা।
শনিবার সারারাত শহরজুড়ে নানা গুজব আর ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তারপরই জেলাবাসীর উদ্দেশে এই বার্তা দিয়েছেন তারা।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোশারফ হোসেন খান বলেন, “শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই স্বাভাবিক হবে সবকিছু।”
এদিকে অবরোধের কারণে মেঘের রাজ্য খ্যাত সাজেক ভ্যালিতে বেড়াতে গিয়ে আটকা পড়েছেন প্রায় দেড় হাজার পর্যটক।
সাজেক জিপ সমিতির লাইনম্যান ইয়াসিন আরাফাত জানান, শুক্রবার সকাল এবং দুপুরের স্কর্ট মিলিয়ে ১১০-১১৫টি জিপ, ৫০টি মাহেন্দ্র ও অটোরিকশা সাজেকে প্রবেশ করেছে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও অনেকে গিয়েছেন। হঠাৎ অবরোধের ঘোষণা আসাতে পর্যটকরা আর ফিরতে পারেননি। পর্যটকরা সাজেকেই আছেন।
সাজেক রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির সহসভাপতি চাই থোয়াই চৌধুরী জয় জানান, সাজেকে বর্তমানে প্রায় ১৪০০ এর মত পর্যটক অবস্থান করছেন। যেহেতু পর্যটকরা ফিরে যেতে পারেননি, তাই রিসোর্ট কটেজ মালিক সমিতির পক্ষ থেকে পর্যটকদের থাকার খরচ ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরিন আক্তার বলেন, “অবরোধের কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় পর্যটকদের কোনো গাড়ি ছাড়া হয়নি। সাজেকে পর্যটকরা আটকা পড়েছে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে তারা সকলে নিরাপদে ও সুস্থ আছেন।”
সম্প্রীতি সমাবেশে যেসব সিদ্ধান্ত
রাঙামাটিতে সহিংসতার ঘটনার পর রোববার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সম্প্রীতি সভায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে- শহরের পৌরসভা থেকে বনরূপা পর্যন্ত এবং কলেজ গেইট থেকে জিমনেসিয়াম অবধি সভা-সমাবেশ করা যাবে। কিন্তু জিমনেসিয়াম থেকে বনরূপা এলাকায় কোনো মিছিল সমাবেশ করা যাবে না। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে কোনো মিছিল-সমাবেশ করা যাবে না।
তবে আগে থেকে অনুমতি সাপেক্ষে ধর্মীয়, সামাজিক শোভাযাত্রা করা যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে চিকিৎসা সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হবে, পুরো শহর সিসিটিভি ক্যামেরায় আওতায় আনা হবে।
দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করা হবে, গুজব রটনাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে, বনরূপার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে পর্যায়ক্রমে সহযোগিতা করা হবে, শহরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সম্প্রীতি রক্ষায় কমিটি হবে, শহরের পাঁচটি এলাকায় সম্প্রীতি সমাবেশ করা হবে।
সম্প্রীতি সভায় বক্তব্য দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং, রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নগেন্দ্র চাকমা, জামায়াতের জেলা আমির মো. আব্দুল আলিম, রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন রুবেল, রাঙামাটি অটোরিকশা চালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাবুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা।
জেলা প্রশাসক মোশারফ হোসেন খানের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর রাঙামাটির জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এরশাদ হোসেন চৌধুরী, পুলিশ সুপার এস এম ফরহাদ হোসেনসহ দায়িত্বশীল বিভাগের প্রতিনিধিরা।
‘সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে চাই’
আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং বলেন, “উপদেষ্টাদের কাছ থেকে আমরা কোনো বার্তা পেলাম না। তারা কোনো ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি। যদি তারা আঞ্চলিক পরিষদ, মসজিদ, বৌদ্ধ বিহারের ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা পরিদর্শন করতেন তাহলে দেশের মানুষ, পাহাড়ের মানুষ একটা মেসেজ পেত।
তিনি বলেন, “সম্প্রীতি মিছিল করতে হলে জেলা পরিষদ প্রতিনিধি, আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করুন। আমরা সবাই অধৈর্য্য হয়ে গেছি। মশাল মিছিল থেকে এই প্রোগ্রামের প্রস্তুতি থাকলেও আপনারা কেন ব্যবস্থা নিলেন না? সামনে-পেছনে কোনো পুলিশ নেই। পাহাড়ের কিছু হলেই পাহাড়ি-বাঙালি হামলা, দাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব কি এতই বিলুপ্ত হয়ে গেছে? আমরা সম্মিলিতভাবে এটাকে মোকাবিলা করতে চাই।”
পুলিশ সুপার এস এম ফরহাদ হোসেন বলেন, “আমাদের অনেক গাড়িতে হামলা করেছে। পুলিশ বক্স ভেঙে দেওয়া হয়। আমরা ধৈর্যে্যর সঙ্গে মোকাবেলা করেছি। এই ঘটনায় বিভিন্ন জায়গা থেকে ফেইসবুকে উসকানি দেওয়া হয়েছে। যারা এসব কাজ করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, “এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। তদন্তের কাজ চলছে। যারাই দোষী তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা হত্যা মামলা করেছি। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিসিটিভি স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।”
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, “এই ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। আহত ৬০ জন রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তদন্ত কমিটি ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ শুরু হয়েছে।”
তিনি জানান, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। এমন ঘটনা আর যাতে না হয় সেদিকে সবাইকে সচেতন হতে হবে।