বন্যায় সব শেষ বীরেন্দ্র, জয়ন্তীদের

কোনটা যে ডাকুয়ার হাওরের পূর্ব তীর, আর কোনটা মরা আঙগাঙের পাড়, আলাদা করে চেনার উপায় নেই। আষাঢ় মাসের বানে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠইর ইউনিয়নের ডাকুয়ার হাওর আর গ্রামগুলো এখন একাকার।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিশামস শামীম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2022, 09:14 AM
Updated : 1 July 2022, 09:16 AM

বসতিগুলো ডুবে আছে। মেঘলা আকাশ থেকে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। মাঝেমাঝেই শোনা যাচ্ছে বজ্রনিনাদ। এর মধ্যেই ছোট একটি নৌকায় দাঁড়িয়ে বীরেন্দ্র রবি দাস (৪০) এবং তার ভাবি জয়ন্তী রবি দাস (৪২) শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাদের ভাঙা ঘরের দিকে।

বন্যার পানি বসতঘর থেকে নামলেও বীরেন্দ্ররা এখনো বাড়ি ফিরতে পারেননি। হাওরের ঢেউয়ে ভেঙে গেছে ঘরের মেঝে ও বেড়া। মেঝে জুড়ে এখন শুধু কাদা। জলে ভেসে গেছে ঘরের সব জিনিসপত্র। ঘুমানোর কাথা-বালিশও নেই।

বীরেন্দ্র বলেন, “আমার মাইজম (মেজো) ছেলে দুর্জয় নোয়াগাঁও প্রাইমারি ইশকুলে তিরিত (তৃতীয় শ্রেণিতে) পড়ে। তার বই খাতা ছাঙ্গো (টিনের ছাদে) তুইল্যা রাখছিলাম। ফানি নামার বাদে আইয়া পাই ভিইজ্যা নষ্ট অই গিছে।

“এক সাপ্তাহ পরো ঘরো আইয়া দেখি ঘরখান কোনওবাদি (কোনোভাবে) দাড়াইয়া আছে। ডেগ, ডেকছি, খেতা, বালিশ, ধান, চাইল, বাসন, কোসন কুন্তা (কিছুই) নাই। সবতা ভাইস্যা গেছেগি। এখন চলতাম কিলা, থাকতাম কিলা?”

দশ বছর আগে শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুক্তাখাই গ্রাম থেকে সদর উপজেলার কাঠইর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের নতুন হাঁটিতে এসে সরকারি খাস জমিতে ঘর তুলেছিলেন বীরেন্দ্র ও তার ভাই রেনু রবি দাস।

তারা এতিম দুই ভাই হাওরের তীরে রাত দিন মাটি কেটে জনবসতিহীন স্থানে বানিয়েছেন বসতঘর। জুতা পলিশ ও সেলাইয়ের টাকা তিলে তিলে সঞ্চয় করে সস্তা টিন দিয়ে ঘর তুলে বসবাস শুরু করন।

গত ১৬ জুন গভীর রাতে যখন বুক সমান পানি উঠে গেল, সেই ঘর বাঁচানোর আশা বাদ দিয়ে ডুবে যাওয়া মাটির রাস্তা ধরে তারা স্থানীয় কামালবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। স্ত্রী ও চার সন্তানসহ আশ্রয় নেন এক বারান্দায়।

বীরেন্দ্র জানান, কষ্টের সংসারে তিলে তিলে জরুরি জিনিসপত্র কিনেছিলেন। এখন ঘরে কিছুই নেই। সস্তায় কেনা খাট, বাসন কোসন ও কাপড় রাখার শোকেস দুই সপ্তাহ পানিতে থেকে নষ্ট হয়ে খুলে খুলে পড়ছে।

এখনো কামাল বাজারেই তারা আছেন। দিনের বেলায় এসে ভাঙা ঘর দেখে যান। পানি পুরা নেমে গেলে আবার কীভাবে ঘর তোলা যায়, সে কথাই তারা ভাবছিলেন।

কিন্তু এর মধ্যে বৃহস্পতিবার থেকে আবার পানি বাড়ছে কিছু এলাকায়। তাই নতুন করে বুক কাঁপছে বীরেন্দ্রদের।

বীরেন্দ্রর ঘরের পাশেই ছিল ভাই রেনু রবি দাসের ঘর। স্ত্রী জয়ন্তী দাস আর এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার।

বাজারে বাজারে জুতা পলিশ করে সংসার চালান রেনু। দীর্ঘ দিনের চেষ্টায় সংসারের কিছু জিনিসপত্র করেছিলেন। কিন্তু বন্যা সব নষ্ট করে গেছে।

জয়ন্তী বলেন, “আমাদের ১৫-২০ মণ ধান ছিল। এগুলো সারা বছরের খোরাকি। শুকনো ধান গোলা থেকে ভেসে গেছে। যা আছে, তাও পচে নষ্ট হয়ে গেছে।”

তিনটি গরু পালতেন জয়ন্তী, সেই গরু নিয়ে তিনি এখন কষ্টে আছেন। নিজেরা সড়কে ত্রিপল দিয়ে ঝুপড়ি করে থাকতে পারলেও গবাদিপশুকে খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় রাখতে হচ্ছে। বন্যা খড় ভেসে গেছে। বন্যার পানিতে একটি ভেড়াও মরে গেছে।

ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় শঙ্কিত এ নারী বলেন, “এখন সংসারের বিছানাপত্র, বালিশ, বাসন-কোসন কীভাবে কিনে আবার সংসার জোড়া লাগাব, এই চিন্তায় ঘুম আসে না। ভেঙে যাওয়া ঘরে কখন ফিরব, কীভাবে সারাব, সেটাও জানি না।“

বীরেন্দ্র জানান, তারা এমন এক জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে গাড়িতে করে পৌঁছানো যায় না। ফলে কোনো ত্রাণও পাচ্ছেন না।

তবে বৃহস্পতিবার দুপুরে লেখক শিল্পী সাংবাদিক ও প্রকাশকরা নৌকায় তাদের গ্রামে এসে তাকে ও তার ভাবিকে ৪ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দিয়েছেন বলে জানান বীরেন্দ্র।

তিনি জানান, বন্যা শুরুর পর একবার শুকনো খাবারের প্যাকেট পেয়েছিলেন। আরেকদিন উপজেলা পরিষদ থেকে রান্না করা খিচুড়ি দিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে ওই খিচুরি খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছিল।

কাঠইর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল মোক্তাদীর বলেন, রেনু রবি দাস ও বীরেন্দ্র রবি দাসরা গরিব ও হতদরিদ্র পরিবারের মানুষ। দুর্গম ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রামে বসবাসের কারণে তারা সহায়তার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

“আমি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আমার মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি যত সহায়তা আসে, চেষ্টা করি তা দিয়ে ওদের সাহায্য করতে।”