আওয়ামী লীগের সম্মেলন: ২৬ বছরে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে দীপংকর

আড়াই দশকের বেশি সময় রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজের ‘আধিপত্য’ ধরে রাখা দীপংকর তালুকদার এবারের সম্মেলনে সভাপতি পদে তারই এক ‘শিষ্যের’ কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছেন।  

ফজলে এলাহী রাঙামাটি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2022, 01:52 PM
Updated : 24 May 2022, 04:11 AM

দীর্ঘ ১০ বছর পর মঙ্গলবার রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সভাপতি পদে সংসদ সদস্য দীপংকর ছাড়াও প্রার্থী হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা।

আর সাধারণ সম্পাদক পদে লড়বেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. মুছা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী কামালউদ্দিন। আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, জেলার মোট ২৪৬ কাউন্সিলর ভোটের মাধ্যমে এদিন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করবেন।

২০১৯ সালে সব প্রস্তুতি শেষ করার পরও সম্মেলনের পাঁচদিন আগে তা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। দুই বছর পরের সেই সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা ডালপালা মেললেও প্রার্থীরা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদের কথাই বলেছেন। 

সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত ছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝিতে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করা শুরু করেন। ১৯৯১ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন। এরপর একে একে ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৮ সালে তিনি সংসদ সদস্য হন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যান্ত তিনি পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

দীপংকর জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি হন ১৯৯৬ সালের সম্মেলনে। এরপর ২০০২ সাল এবং ২০১২ সালের সম্মেলনেও তিনি একই পদে বহাল থাকেন। এ তিনটি জেলা সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে ভোট হলেও সভাপতি পদে দীপংকরের বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থী ছিল না।

২৬ বছর পর তার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নিখিল কুমার চাকমা। নব্বইয়ের দশকের শেষে রাজনীতিতে আসা নিখিল একসময় দীপংকরের ‘শিষ্য’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সেই ‘সুবাদে’ রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নিখিল কুমার চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলের কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীদের অনুরোধেই আমি প্রার্থী হয়েছি। দীপংকর দাদা দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি মনে করছি, আমাকে নির্বাচিত করলে দলের কাজে আরও গতি আসবে এবং দলের নেতাকর্মীদের আরও বেশি সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে পারব।”

“জয়ের ব্যাপারে ভীষণ আশাবাদী আমি।”

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী হাজী মো. মুছা (বায়ে) এবং হাজী কামাল উদ্দিন।

অন্যদিকে বর্তমান সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, “আমাদের সম্মেলনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশে সব প্রার্থী যার যার প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এটা খুবই ভালো একটা দিক, দলের গণতন্ত্রের চর্চা অবারিত হয়েছে।

“কাউন্সিলররাও স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন বলে আমার বিশ্বাস। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।”

সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনকে ঘিরে জেলাজুড়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন সমর্থক-অনুসারীরা। এ নিয়ে রয়েছে টানটান উত্তেজনাও। কেউ কেউ দীপংকরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ‘ধারাবাহিকতা বজায়’ রাখার কথা বললেও; বিরোধীরা নিখিলকে নিয়ে মাঠে ‘পরিবর্তনের বার্তা’ দিচ্ছেন।    

নিখিলের পক্ষের সমর্থক হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জমির উদ্দীন।

তিনি বলেন, “আমাদের অবস্থান ব্যক্তি দীপংকরের বিরুদ্ধে নয়। সাংগঠনিক স্বার্থে আমরা দলকে আরও শক্তিশালী করতে পরিবর্তনের পক্ষে। দীপংকর তালুকদারকে কেন্দ্রে বড় দায়িত্ব দেওয়া হোক; আমরা নতুনদের সঙ্গে নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করতে চাই।”

অপরদিকে বাঘাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বৃষ কেতু চাকমা এবং রাঙামাটির সাবেক পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের অনুসারী।

বৃষ কেতু চাকমা বলেন, “দীপংকর উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতা নয়। পার্বত্য জনপদের সর্বত্র আজ আওয়ামী লীগের পতাকা যে উড়ছে এর কৃতিত্ব দীপংকরের। আজ জেলার কিছু নেতা ব্যক্তিস্বার্থে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারাও এক সময়কার সুবিধাভোগী। অনেক কিছুই পেয়েছে দীপংকরের কাছ থেকে। আরও বেশি পাওয়ার চাহিদা পূরণ না হওয়ায় এখন ‘তৃতীয় পক্ষের’ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। কিন্তু তারা সফল হবে  না। তৃণমূল নেতাদের ভোটেই পুনঃনির্বাচিত হবেন দীপংকর।”

সাবেক পৌর মেয়র হাবিবুর বলেন, “সারা দেশের সঙ্গে পার্বত্য রাজনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। এখানে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি আঞ্চলিক দলগুলোর অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয় আওয়ামী লীগকে। সুতরাং পরীক্ষিত নেতাদের নির্বাচিত করতে হবে। দীপংকর তালুকদার ও মুছা মাতব্বর সেই পরীক্ষিত নেতা।”

এদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়া হাজী মুছা মাতব্বর ও হাজী কামাল উদ্দিন দ্বৈরথও বেশ জমে উঠেছে। সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হাজী কামাল মূলত ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ। নব্বই দশকের শেষের দিকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া কামাল জেলা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ কাউন্সিলে ভোটের লড়াইয়ে হেরেছেন মুছার কাছেই। তাদের সমর্থক-অনুসারীরা নানা কৌশলে ভোট প্রার্থনা করছেন।  

হাজী মুছা মাতব্বর বলেন, “আমি ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে রাজনীতি শুরু করেছিলাম, সেখানেই স্থির থাকব আমৃত্যু। শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে পাহাড়ে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভীতের ওপর দাঁড় করাতে জীবনবাজি রেখে কাজ করেছি এবং করে যাচ্ছি।”

“আমাদের নেতাকর্মীরা, কাউন্সিলররা অবশ্যই তার মূল্যায়ন করবেন, এই বিশ্বাস আমার আছে।”

অপরদিকে হাজী কামাল উদ্দিন বলেন, “আমার পুঁজি হচ্ছে সততা। এই সততার যারা সমর্থক তারা আমাকে নির্বাচিত করবে। অনেক টাকাপয়সার ছড়াছড়ি হচ্ছে, তাতে কাজ হবে না।”