শাম্মী আরা পারভিন (৩৫) নামের ওই শিক্ষক ৪ নম্বর পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন; তার স্বামী আতাউর রহমান আতা সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
ভেড়ামাড়া উপজেলার ষোল দাগ এলাকা থেকে ২০১২ সালে কুষ্টিয়া শহরে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন আতাউর, ধীরে ধীরে উঠে আসেন জেলা আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কেন্দ্রে।
দুদক সদরদপ্তরে আসা একটি অভিযোগের ভিত্তিতে শাম্মী আরা পারভীনের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া টাকা এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উৎসের সন্ধান শুরু হয় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে। এরপর দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জাকারিয়াকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তদন্ত শুরুর পর শাম্মী আরার স্বামী আতাউরের বিরুদ্ধে ‘চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বালুমহাল ব্যবসাসহ নানা ধরনের অবৈধ ব্যাবসা পরিচালনা এবং সেসব থেকে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ার তথ্য’ বেরিয়ে আসে বলে জানান দুদক কর্মকর্তা জাকারিয়া।
দুদকের কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, আতাউর ও তার স্ত্রীর বিষয়ে পাওয়া সব তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে তারা মামলার পথে এগুবে। তবে আতাউর রহমান আতা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
শাম্মী আরা পারভীনের বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা জাকারিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন "তদন্তে সঞ্চয়ী স্কিম হিসাবে প্রায় অর্ধশত কোটি নগদ টাকা ছাড়াও উচ্চমূল্যের জায়গা-জমি, ভবন, মার্কেটসহ স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির একত্রে আনুমানিক মূল্যমান শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।"
একজন স্কুল শিক্ষিকার ব্যাংক হিসাবে একসঙ্গে জমা হওয়া এত টাকার উৎসের সন্ধানের সূত্র সন্ধানে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার নাম উঠে আসে জানিয়ে দুদক কর্মকর্তা বলেন, "সংগত কারণেই এটি হয়ে ওঠে দুদক তদন্তের টার্নিং পয়েন্ট।"
এছাড়া একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হয়ে শাম্মী আরা তার স্বামীর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ উপায়ে শত কোটি টাকার সম্পদ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন জাকারিয়া।
অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জাকারিয়া গত ৩০ মার্চ সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও ব্যাংকে চিঠি দিয়ে আতার লেনদেনের তথ্য জানান।
শাম্মী আরার পাশাপাশি তার স্বামীর বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান মুখ্য হয়ে উঠেছে জানিয়ে জাকারিয়া বলেন, "ট্যাগিং সিস্টেমে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মামলা একত্রেই প্রক্রিয়াধীন।"
এদিকে, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের নির্বাহী মুন্সি মো. মনিরুজ্জামান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহিদুর রহমান মন্ডল, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিরুল ইসলাম, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌলী মো. ইসতিয়াক ইকবাল হিমেলসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা আতার বিষয়ে দুদকের চিঠি পাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তারা বলেছেন, দুদকের চিঠি অনুযায়ী কেবল 'মেসার্স আতাউর রহমান' নামের প্রতিষ্ঠানের স্বতাধিকারী আতাউর রহমানের বিষয়ে সব তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। আতাউর রহমান আতার অন্য নামে আরও অন্তত ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করেছে।
সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে তথ্য পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে গত বুধবার বিকালে কুষ্টিয়ার দুদক কার্যালয় থেকে বলা হয়, সব তথ্য যাচাইবাছাই শেষে মামলা প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে।
আতাউরের উত্থান সম্পর্কে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসগর আলী বলেন, আতাউর ২০১২ সালে গ্রাম থেকে কুষ্টিয়া শহরে এসে মজমপুরে একটি ভাড়া বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে ওঠেন। সে সময় পৌর আওয়ামী লীগের লীগের সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিজ এক ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কার হলে আতা ভারপ্রাপ্ত হয়ে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন। পরে কাউন্সিলের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক হয়ে ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন।
এরপর আতাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মন্তব্য করে আসগর আলী বলেন, “স্কুল কলেজ মাদ্রাসসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য করে শততোটি টাকা হাতিয়েছেন, এছাড়া কুষ্টিয়া মেমিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণে তার দুর্নীতির কথা সবাই জানে।"
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা শহিদুর রহমান বলেন, "২০১৯ এ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করা হলফনামায় আতার নিজের এবং স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণে যথাক্রমে ১৫ লাখ এবং ৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকার ব্যাংক হিসাব উল্লেখ করেছিলেন।"
এ ছাড়া, তিনি সরকারি কোনো লাভজনক উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার নন বলেও হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন আতাউর।
চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "একটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক গ্রুপ হীন স্বার্থে পরিকল্পিতভাবে এসব অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে। জ্ঞাত আয় বহির্ভুত বা অপ্রদর্শিত কোনো সম্পদ আমার নেই। দুদক মামলা করলে আমি তা মোকাবিলা করব।"
শাম্মী আরার সঙ্গে কথা বলতে কয়েকবার চেষ্টা করেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।