খাগডহরের যুদ্ধে প্রথম বিজয়

একাত্তরের ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির উপর চালানো হত্যাযজ্ঞের পর বাঙালি পুলিশ, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস), সেনাবাহিনী সদস্যসহ সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে; তার দুদিনের মাথায় ময়মনসিংহের খাগডহরে মেলে প্রথম বিজয়।

ইলিয়াস আহমেদ ময়মনসিংহ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2022, 05:31 PM
Updated : 25 March 2022, 05:31 PM

যুদ্ধের শুরুতে তখনও সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশে কর্মরত বাঙালি সদস্যরা কর্মস্থল ত্যাগ করেননি। ওই সময় স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানিরা নানা ষড়যন্ত্র করেছিল বাঙালিদের নিরস্ত্র ও হত্যা করতে। কিন্তু সবখানে তাদের কৌশল বাঙালিদের বোকা বানাতে পারেনি। তার একটি বড় উদাহরণ ময়মনসিংহ শহরতলির খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের যুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতে এই যুদ্ধে ওই ক্যাম্পের বাঙালি ইপিআর সৈনিকরা শুধু পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছেন তাই নয়, পরিকল্পিত বাঙালি হত্যার ছক পাল্টে দিয়ে তাদের উচ্ছেদও করেছিলেন। দুই দিনের ওই যুদ্ধে ১২১ জন পাক সেনা নিহত হন; বাঙালি সেনা নিহত হন ছয় জন।     

শহরের পশ্চিম দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে খাগডহর এলাকায় ছিল ইপিআরের ২ নম্বর উইং হেডকোয়ার্টার্স। সেখানকার কমান্ডার ছিলেন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস। তার নেতৃত্বে প্রায় আড়াইশর মতো অফিসার ও সৈনিক ছিলেন; তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন অবাঙালি।

২৭ মার্চ বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের সঙ্গে পাকিস্তানি ইপিআরের সশস্ত্র যুদ্ধ হয়। সেদিন রাত ১২টা ১০ মিনিটের দিকে ইপিআর ক্যাম্পে গোলাগুলি শুরু হলে ইপিআরের বাঙালি সৈনিক শেখ হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে সাত থেকে আটজনের একটি দল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করলেও এখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা সেদিনের গৌরবোজ্জ্বল যুদ্ধের স্মরণে স্মৃতিস্মারক নির্মাণের দাবি জানান। 

শেখ হারুন অর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেদিনের যুদ্ধের বর্ণনা দেন। স্মৃতিচারণ করতে করতে হারিয়ে যান বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়ের কথামালায়।  

শেখ হারুন অর রশিদ বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণের পর এদেশের সাধারণ মানুষ, সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং ইপিআর [বর্তমান বিজিবি] সবাই স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স এবং রাজারবাগে যে ঘটনা ঘটেছিল সেটি আমরা শুনেছিলাম। আমাদের ক্যাম্পটি একটি সেমি ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে না বের হতে পারলেও দেশের খবরগুলো পেতাম। ওইদিন থেকে আমরা সাবধান হতে শুরু করি।

“২৬ মার্চ উইং কমান্ডার কমর আলী আব্বাস আমাদের ডেকে বলেন, ‘যারা বাঙালি আছ তারা অস্ত্র জমা দিয়ে দাও। তোমরা অনেক পরিশ্রম করেছ, একটু বিশ্রামে যাও।’ সেদিন থেকে আমাদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। আমরা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকৃতি জানাই।

“২৬ মার্চ হঠাৎ করে বড় ধরনের খাবারের আয়োজন করে সবাইকে এক সঙ্গে খেতে বলা হয়। তখন আমরা বুঝেছিলাম অস্ত্র রেখে সবাই একসঙ্গে খেতে গেলে তারা অস্ত্র নিয়ে নেবে। এমন চালাকি বুঝতে পেরে চার থেকে পাঁচজন করে একসাথে খাবার খেতে গিয়েছি। ওই সময়ের প্ল্যানও তাদের সফল হয়নি।

“পরে রাতে ১০টার দিকে দুইজন হাবিলদার পাঠান ঘটক এবং উমরজান যুদ্ধবেশে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে আমাদের বেরাকগুলো দেখতে শুরু করে কে কীভাবে আছে। এ বিষয়টির পর আমরা (নান্নু, আফতাব, আনিস, কাজী সাঈদ, বাবু, মান্নান এবং ওয়্যারলেস অপারেটর ফরহাদ) একটু চিন্তিত হয়ে পড়ি। আমরা বোঝার চেষ্টা করছিলাম এরা আজকে এত ঘোরাঘুরি করছে কেন। পরে তারা প্রশ্ন করে আমরা ঘুমাচ্ছিলাম না কেন। তাদের প্রশ্নের পর লাইট বন্ধ করে আমরা শুয়ে পড়ি; কিন্তু ঘুমায়নি। অস্ত্রগুলো সঙ্গে রাখি। একটু পর রুমের পাশে বুটের শব্দ শুনতে পাই।”

এরপর যে ঘটনা ঘটেছিল তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের বীরত্বের এক অমর কাহিনি।

হারুন বলতে থাকেন, “রাত পৌনে ১২টা দিকে রাইফেলের গুলির একটি শব্দ আসে কানে। এ সময় রুম থেকে বের হয়ে খুঁজতে শুরু করি কোনদিক থেকে আওয়াজ আসল। সন্দেহ ঘনীভূত হলে ম্যাগাজিন লোড করি। এরপর ১২টা ১০ মিনিটে ব্যারেলের পিস্তলের আওয়াজ আসে ক্যাপ্টেনের বাংলো থেকে। তখন আমরা শতভাগ নিশ্চিত হই বিপদ অতি নিকটে। কেননা এটাই হল সিগন্যাল। হয়তো ব্যাক করতে হবে, না হয় অ্যাটাক করতে হবে। ফায়ারের সঙ্গে সঙ্গে হাবিলদার পাঠান ঘটক এবং উমরজান সামনের দিকে এসে আমাদের ক্রস করে যাওয়ার সময় নান্নুকে বললাম, আর চিন্তা করে লাভ নেই, মারো। পরে নান্নু এলএমজি দিয়ে মারলে দুইজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, মারা যায়। শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ।

হারুন তিনতলায় উঠে একটা ফায়ার করেন এবং উর্দুতে বলেন কেউ যেন বের না হয়। সবাই নিস্তব্দ হয়ে পড়ে। এভাবে সারারাত যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে ওদের গুলি শেষ হয়ে যায়।

“আমার পায়ে গুলির একটু আঁচড় লাগে। আমাদের অন্য কেউ আহত হয়নি। এদের ৮৭ জন মারা যায়। পরে স্থানীয় সাঈদ নামে এক লোক এসে খবর দেয় ঘুন্টি রেললাইনে কাউন্টার অ্যাটাক করছে পাকিস্তানিরা। ১৬ থেকে ১৭ জন পাকসেনা গুলি করতে করতে আমাদের ক্যাম্পে আসার চেষ্টা করছে। এমন অবস্থায় জয় বাংলা স্লোগান ধরে আমরাও অস্ত্র নিয়ে ছুটে চলি। রেললাইনের পাশে আমরা পাঁচজন পজিশন নেই। ওরা ছিল ১৭জন।”

গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাকিস্তানিদের গুলি শেষ হয়ে গেলে তারা পেছন হটতে বাধ্য হয়।

হারুন বলেন, “ওদের দলে আমাদের দেলোয়ার নামে একজন বাঙালি ছেলে ছিল। পাকসেনাদের দৌড় দেখে দেলোয়ার আনন্দে নাচছিল। ওদের একজন ছিল হাসিবুল্লাহ নামে। সে রেললাইনের পাশে ওঁৎ পেতে ছিল। সেটি আমরা খেয়াল করেনি। আমাদের নজর ছিল বড় অফিসারদের দিকে। আমি তখন দেলোয়ারকে বলি তুমি শুয়ে পড়ো। তার জন্য আমাদের গুলি করতে সমস্যা হচ্ছিল। দেলোয়ার শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাসিবুল্লাহ তাকে মাথায় গুলি করে। গুলিতে দেলোয়ারের মগজ ছিঁটকে পড়ে যায়। পরে আমি এলএমজি নিয়ে ব্রাশ ফয়ার করে হাসিবুল্লাহকে মারি। তারপর ১৬ জন কমান্ডারকে ধরে গুলি করে হত্যা করি। নিহত ১৭ জনের লাশ ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে বালুর নিচে পুঁতে রাখি।”

২৬ মার্চ রাত শুরু হওয়া ওই যুদ্ধ শেষ হয় ২৮ মার্চ বিকালে। দুই দিনের যুদ্ধে ১২১ জন পাক সেনা নিহত হয়; বাঙালি মারা যান ৬ জন, বলেন হারুন।

ইপিআর ক্যাম্প থেকে ময়মনসিংহের প্রথম যুদ্ধ শুরু হলেও সেখানে কোনো স্মৃতিফলক না থাকায় আক্ষেপ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হারুন অর রশিদ।

“বিষয়টি আমাদের কাছে খুব খারাপ লাগে। ক্যাম্পের ভেতরে একটি নাম ফলক থাকলেও তা অসম্পন্ন।”

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়া উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, “যেহেতু প্রথম মুক্তিযোদ্ধের সুচনা হয় ইপিআর ক্যাম্প থেকে, সেহেতু সেখানে একটা স্মৃতিফলক থাকা উচিত ছিল। ক্যাম্পের ভেতরে একটি নামফলক থাকলে তা সাধারণ মানুষের নজরে আসছে না। আমাদের দাবি রাস্তার ধারে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।”

ময়মনসিংহ বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মাহমুদুল হক বলেন, “প্রথম যুদ্ধ এই ক্যাম্প থেকেই শুরু হয়। এখানে সাধারণ মানুষসহ নতুন প্রজন্মকে যুদ্ধের ইতিহাস জানানোর জন্য স্মৃতিফলক করা দরকার বলে আমি মনে করি।”