চারুবালার মৃত্যুর পর উত্তাল হয়ে ওঠে যশোর

একাত্তরের ৩ মার্চ যশোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা যান চারুবালা কর। তার মৃত্যুর পর উত্তাল হয়ে ওঠে যশোর শহর। হাজার হাজার মানুষ মিছিলে যোগ দেয়। বুলেটবিদ্ধ চারুবালার মরদেহ বহন করা হয় মিছিলের অগ্রভাগে।

শিকদার খালিদ যশোর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2022, 03:44 AM
Updated : 24 March 2022, 03:44 AM

৩ মার্চ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে ছিল যশোরবাসী। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর যশোরেও গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। তারপর চলতে থাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি।

এভাবে সারা দেশেরে মতো যশোরের মানুষও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রুকুনউদ্দৌল্লাহ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার রবিউল আলম সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর, বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পার করে।

১৯৭১ সালের মার্চে যশোর সমুদ্রের মতো উত্তাল হয়ে উঠল। গগণবিদারী শ্লোগানে যশোরের মাটি কাঁপল। চারিদিকে জয় বাংলা ধ্বনি। তরুণরা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে। সমস্বরে তারা চিৎকার করে চলেছে – লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। ইয়াহিয়া-ভুট্টো দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।

৩ মার্চ সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মিছিল ঈদগাহের দিকে ছুটছিল। একটি মিছিল শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের সামনে গিয়ে সেখানে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। পাহারারত সৈন্যরা জনতাকে ভয় দেখাচ্ছিল রাইফেল তাক করে। এ সময় জনতার মধ্য থেকে কেউ কেউ ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে সৈন্যদের দিকে।

রুকুনউদ্দোল্লাহ বলেন, ভবনের শীর্ষে অবস্থানরত পাহারাদার সৈন্যরা এ সময় হঠাৎ এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। গুলিতে বৃদ্ধা চারুবালা কর নিহত হন। তিনি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের সামনে তার বাড়িতে দাঁড়িয়ে জনতার বিক্ষোভ দেখছিলেন।

“চারুবালার মৃত্যুর খবর দাবানলের মতো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তখন আবার হাজার হাজার মানুষ মিছিল বের করে। বুলেটবিদ্ধ চারুবাল করের মরদেহ বহন করা হয় মিছিলের অগ্রভাগে।”

মিছিলের নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী মশিয়ূর রহমান।

রুকুনউদ্দোল্লাহ বলেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রোডের সরকারি খাদ্যগুদামে পাহারারত পাকিস্তানি সৈন্যরা ফাঁকা গুলি ছোড়ে মিছিল দেখে। গুলির শব্দে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরক্ষণেই আবার জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং বিক্ষোভ প্রকাশ করতে করতে সার্কিট হাউসের দিকে এগোতে থাকে।

সার্কিট হাউসকে তখন সেনাবাহিনী সামরিক আদালত হিসেবে ব্যবহার করত বলে জানান রুকুনউদ্দোল্লাহ।

“মিছিলটি সেখানে পৌঁছে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মিছিলকারীরা সেনাবাহিনীর দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ে। এক পর্যায়ে সার্কিট হাউসে ঢোকার চেষ্টা করলে সেনাবাহিনীর কর্নেল তোফায়েল মিছিলে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে মশিয়ূর রহমান ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়ান। তিনি সেনাবাহিনীকে গুলি চালানো থেকে বিবৃত্ত করে জনতাকে ঈদগাহের দিকে নিয়ে যান।”

তিনি জানান, এদিন জেলা প্রশাসকের দপ্তার কালেক্টরেট ভবনে বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা সেখানে উত্তোলন করে। পরে জজ কোর্ট ভবনেও পতাকা তোলা হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিববাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার রবিউল আলম বলেন, ৩ মার্চ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে যশোরবাসী ছিল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাথে তারাও প্রহর গুণছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের জন্য। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ভেবে জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়। যশোরেও গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ।

রবিউলের স্মৃতিচারণ করেন, তখন শহরের নিয়ন্ত্রণভার মূলত সংগ্রাম পরিষদের হাতে ছিল। সংগ্রাম পরিষদ পুরোপুরি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। তাদের কাছে অনুভূত হয়, হানাদার বাহিনী আন্দোলন সংগ্রাম নস্যাৎ করতে শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। তাই হানাদার বাহিনীর সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য উদ্যোগ নেয় সংগ্রাম পরিষদ।

“সংগ্রাম পরিষদ ছাড়াও শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়; আলাদাভাবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও ছিল। আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন ছাড়াও কমিউনিস্ট পার্টি (মনি সিংহ), ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।”

রবিউল বলেন, ন্যাপের কাজী আব্দুস শহীদ লালের ভূমিকা স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের শক্তি যুগিয়েছিল দারুণভাবে। তার নেতৃত্বে প্রতিরোধ আন্দোলনের শুরুতে যশোর পুলিশ লাইন থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল; যা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

রুকুনউদ্দোল্লাহ জানান, সংগ্রাম কমিটি যশোর জেলা শাখার উদ্যোগে থানা ও মহাকুমা কমিটি গঠন করা হয়। তৃণমূল পর্যায়ে ১১ সদস্যের কমিটি করার জন্য এ দুই শাখার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সাথে বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে ছাত্র ও যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়। যশোর এমএম কলেজ ও শংকরপুরে স্থাপিত হয় এ প্রশিক্ষণের প্রধান দুইটি ক্যাম্প।

বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন নান্নু ও ইপিআর-এর নায়েক সেকেন্দার আলী দুইটি ক্যাম্পের প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন।

যশোর শহরের পশ্চিম প্রান্তে সেনানিবাস। সংগ্রাম পরিষদ সেখানে সব ধরনের পণ্যসহ খাদ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। সরকারি বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা জনতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে নেমে আসে।

রুকুনউদ্দোল্লাহ বলেন, পুরো যশোর জেলা এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় সেনা কর্মকর্তারা আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের নামে সংগ্রাম কমিটির নেতাদের আটকের ফন্দি আঁটেন। এর দায়িত্ব পড়ে কর্নেল তোফায়েলের উপর। তিনি নেতৃবৃন্দকে ২৫ মার্চ সকাল ৮টায় সেনানিবাস এলাকায় আলোচনায় অংশ গ্রহণের আহ্বান জানান। তার অনুনয় বিনয়ের পর নেতৃবৃন্দ আলোচনায় বসতে রাজি হন।

এর মধ্যে আসে ২৩ মার্চ। এদিন দেশব্যাপী স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিবসটি উদযাপন করেন। যশোরেও ব্যাপকভাবে পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি অফিসেও পতাকা তোলা হয়। এদিন বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-যুবকদের প্রথম কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় জেলা প্রশাসক কার্যালয় এলাকার নিয়াজ পার্কে।

রুকুনউদ্দোল্লাহ বলেন, এদিকে কর্নেল তোফায়েলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৫ মার্চ যশোরের বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেনানিবাসে আয়োজিত সভায় যোগ দেন। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষ নেত মশিয়ূর রহমান ওই সভায় যাননি।

“তিনি যশোরের তৎকালীন পুলিশ সুপারের মাধ্যমে সেনা কর্তৃপক্ষের চক্রান্তের কথা জানতে পারেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা মশিয়ূর রহমানকে সভায় না যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে অনুপস্থিত থাকেন।”

তিনি বলেন, মশিয়ূর রহমানের অনুপস্থিতিতে আলোচন চালানো সম্ভব নয় বলে সভার যাওয়া অন্য নেতারা আর এক দিন সময় নির্ধারনের কথা বলেন। সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের কৌশলে আটকে রাখার চেষ্টা চালায় এবং তাদের দুপুরের খাবার খেয়ে যাবার কথা বলেন। নেতৃবৃন্দ তাতে রাজি না হলে রাতে খাবার করা হয়। তারা তাতেও রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত আহূত সভা পণ্ড হয়ে যায় এবং নেতৃবৃন্দ ফিরে আসেন শহরে।

এই দুই মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণে পাক হানাদার বাহিনীর ষড়যন্ত্রের কথাও উঠে আসে।

সন্ধ্যায় সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষ নেতা মশিয়ূর রহমান, রওশন আলী ও মোশাররফ হোসেনের বাড়িতে হাজার হাজার ছাত্র জনতা সমবেত হয়। কখন কী হয়, ঢাকা থেকে কী নির্দেশ আসে – এসব তথ্য ও করণীয় সম্পর্কে জানতে সবাই আগ্রহী। ওই রাতেই খবর আসে রাতে সেনাবাহিনী সেনানিবাস ছাড়তে পারে। শুধু তাই নয়, তারা নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালির উপর হামলাও করতে পারে। একই সাথে পরামর্শ আসে আক্রমণ রুখতে সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার। এ খবর আসামাত্রই উত্তেজনা বেড়ে যায়। নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সাধারণ মানুষ এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। কেউ কেউ অবস্থান নেয় শহরের আরবপুরে সেনাবাহিনীর প্রধান গেটে। গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৫০টি সৈন্যবাহী গাড়ি যশোর শহর অভিমুখে আসে।

সমবেত জনতা ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সামান্য অস্ত্র নিয়ে তাদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়। তবে ওই দিনের একটি বড় সাফল্য হল যশোর শহরের ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) ক্যাম্পের সব অস্ত্র করায়ত্ব করা।

রুকুনউদ্দোল্লাহ বলেন, “ক্যাম্পে অস্ত্রাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের নেতা সৈয়দ মহব্বত আলীর আত্মীয়। তার সহযোগিতায় মহব্বত আলী সব অস্ত্র সরিয়ে নেন। তার এ দুঃসাহসিক কাজে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ হোসেন।”

২৫ মার্চ কালরাত্রি থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা যশোর শহরে ছিল। তারা টার্গেট করে হামলা চালায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নেতা কর্মীদের বাস ভবন, ছাত্রাবাস ও তাদের সন্দেহভাজন এলাকায়। ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের ১৩শ বাঙালি সেনা বিদ্রোহ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেনসহ ৪০ জন শহীদ হন।