চা পাতায় বাঁধা শ্রমিকের কুড়ির আশায় ‘দা পূজা’

চা গাছের সাথেই বংশ পরম্পরায় বাঁধা চা শ্রমিকের জীবন। তাই বেশি ফলনের আশা চা বাগানের মালিকরাই শুধু করেন না, শ্রমিকদেরও আকাঙ্ক্ষা।

বিকুল চক্রবর্তী মৌলভীবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2020, 04:43 AM
Updated : 17 Dec 2020, 01:04 PM

কাজের সফলতার জন্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনেকেই করেন। তবে চা শ্রমিকদের রয়েছে বিশেষ এক পূজা। ভাল ফলনের আশায় তারা চা গাছ কাটার ‘দা’ দিয়ে এ পূজা করেন; নামটাও ‘দা পূজা’।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাঁতগাও টি এস্টেটের ‘মাকরী ছড়া’ চা বাগানের ২ নম্বর শেকশনে গত সোমবার দুপুরে তেমন এক পূজার আয়োজন করা হয়।

সেখানে গাছে বেশি কুঁড়ি আশায় ‘দা-এর পূজার আয়োজন করে শ্রমিকরা। ছেঁটে দেওয়া একটি চা গাছের নিচে দা রেখে এই পূজা করেন তারা। শ্রমিকদের বিশ্বাস এতে চা গাছে বেশি কুঁড়ি আসে।

সোমবার ‘দা পূজার’ সময় বাগানের শ্রমিক ও সরদারদের সঙ্গে সাঁতগাও চা বাগানের প্রধান ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক আশরাফুল সিদ্দিকী, সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল কুদ্দুছ অভি, মাকরী ছড়া টিলা ক্লার্ক সুরঞ্জিত দাশ ও সাতগাঁও ইউনিয়নের মহিলা সদস্য শোভারাণী কুর্মী উপস্থিত ছিলেন।

বাগান সংশ্লিষ্টরা জানান, চা চাষের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রুনিং বা গাছ ছেঁটে দেওয়ার সময়।

মার্চের মাঝামাঝি সময়ে গাছে পাতা আসতে শুরু করে। ভালো পাতা আসার জন্য এবং গাছ দীর্ঘজীবী হওয়ার জন্য বিশেষ কৌশলে এবং নির্দিষ্ট সময়ে প্রুনিং গুরুত্বপূর্ণ। প্রুনিং ঠিক না হলে পাতা ভালো আসে না; গাছের দীর্ঘ জীবনও হয় না।

প্রুনিংয়ের জন্য অভিজ্ঞ শ্রমিক যেমন প্রয়োজন তেমনি এই কাজে ব্যবহৃত দায়েরও বিশেষ গুরুত্ব আছে। প্রুনিংকে বাগান কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে শ্রমিকরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

‘মাকরী ছড়া’ চা বাগানের প্রধান সরদার গুরুচরণ সৎনামী জানান, প্রতি বছর প্রুনিং শুরুর আগে বিভিন্ন বাগানে শ্রমিকরা প্রথমে একটি চা গাছকে ‘লাইট প্রুনিং’ করে। কয়েক ধরনের প্রুনিংয়ের মধ্যে ‘লাইট প্রুনিং’ একটি। এ পদ্ধতিতে গাছের ২২ ইঞ্চি থেকে ২৮ ইঞ্চি রেখে উপরের অংশ কেটে দেওয়া হয়।

পূজার নিয়মের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, লাইট প্রুনিং করা একটি গাছের নিচে পরিষ্কার করে চা গাছ কাটার দাগুলো সেখানে রেখে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, যেন ভালো প্রুনিং হয় এবং সে গাছে যেন বেশি পাতা আসে।  

গত সোমবার মাকরীছড়া চা বাগানের ২ নম্বর শেকশনে দা পূজা ও প্রুনিং করেন বাগানের প্রধান সরদার গুরুচরণ সৎনামী।

এ সময় তার সঙ্গে বাগানে প্রধান সরদারনী প্রতিমা রানী ও বাগানের ব্যবস্থাপক, সহকারী ব্যবস্থাপক এবং অনান্যরা উপস্থিত ছিলেন।

গুরুচরণ সৎনামী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাছের প্রুনিংয়ের উপর নির্ভর করে বেশি পাতা পাওয়া ও গাছকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা। এটি করতে হয় খুব সতর্ক হয়ে। এটি কাটার সময় শ্রমিকদের সঙ্গে বিশেষ পারদর্শী সরদারদেরও বিষয়টি লক্ষ রাখতে হয়।

তিনি বলেন, এই গাছই তাদের জীবন। চা গাছের পাতায় চলে চা শ্রমিকের সংসার। তাই এই বিশেষ কাজ শরু করার আগে সনাতন ধর্মালম্বী শ্রমিকরা পূর্জাচনা এবং ইসলাম ধর্মালম্বী শ্রমিকরা মিলাদ মাহফিল শেষে কাজ শুরু করে। আর বাগান কর্তৃপক্ষ সবাইকে মিষ্টিমুখ করান।

সাতগাঁও চা বাগান ব্যবস্থাপক রফিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রুনিং ভালো না হলে ভালো চা ফলবে না। এটিকে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। প্রতিবছর পূর্জাচনা ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে তা শুরু করা হয়। শ্রমিকরা আয়োজন করেন তারা খরচ দেন।

রফিকুল জানান, কাজ শুরুর সময় প্রত্যেককে মিষ্টমুখ করান। তার তিনটি বাগানে এই উপলক্ষে প্রায় শত কেজি মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।

এই ব্যাপারে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরিচালক রফিকুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রুনিংকে চা বোর্ড থেকেও অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। উৎপাদন ঠিক রাখতে তারা এই বিষয়ে বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক ও টিলা ক্লার্কদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

প্রুনিং বিষয়ে বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের চা বিজ্ঞানী ড. মো. তৌফিক আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সঠিক প্রুনিংয়ের উপর নির্ভর করে গাছের দীর্ঘজীবীতা।

তিনি জানান, এর একটি সাইকেল রয়েছে। প্রুনিং চার ধরনের। একটি এলপি বা লাইট প্রুনিং, যা গাছ রোপনের পঞ্চম বছরে করতে হয়। এই সময় গাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী ২২ থেকে ২৮ ইঞ্চি রেখে বাকিটা কেটে দিতে হয়। এর সময়কাল ডিসেম্বর মাস।

এর পরের বছর করতে ডিএসকে ডিপ প্রুনিং। এই সময় গাছের উচ্চতা ২৬ থেকে ৩২ ইঞ্চি রেখে পুরোটা কেটে দিতে হয়। এটি জানুয়ারির মধ্যভাগে শেষ করতে হয়।

তৃতীয় বছরে করতে হয় এমএসকে মিডিয়াম প্রুনিং, যার প্রুনিং সীমা ২৮ থেকে ৩৪ ইঞ্চি। এই সময়কাল ১৫ থেকে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে।

চতুর্থ বছরে করতে হয় এলএসকে, যাতে গাছের ২৯ থেকে ৩৫ ইঞ্চির মধ্যে রেখে কাটতে হয়। তা শেষ করতে হয় ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। এরপর পুনরায় এলপি দিয়ে শুরু হবে।

তবে গাছ রোপনের প্রথম বছর গাছকে ডি সেন্টারিং করতে হয়। অর্থাৎ গাছের মধ্যভাগের মূল ডাল ৬ থেকে ৯ ইঞ্চি রেখে কেটে দিতে হবে বলেন ড. তৌফিক।

চা বাগান সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি পরিমিত বয়সের ১২ থেকে ১৪ বছরের চা গাছে বছরে এক কেজি গ্রিন লিফ হয়, যা থেকে ২৫ গ্রাম মেইড টি হবে। আর প্রতি হেক্টরে অন্তত ১৫ হাজার চারা রোপন করতে হয়।