করোনাভাইরাস: ঢাকা ঘেঁষা টাঙ্গাইল কতটা নিরাপদ

প্রতিদিনই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর ফেরত মানুষের আনাগোনা চলছে টাঙ্গাইলে। এছাড়া ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের সড়ক এ জেলার ওপর দিয়ে হওয়ায় পণ্যবাহী ট্রাকসহ নানা যানবাহন ও মানুষের চলাচল লেগেই আছে।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধিএম এ রাজ্জাক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2020, 02:06 PM
Updated : 3 May 2020, 02:06 PM

টাঙ্গাইলকে করোনাভাইরাসের সংক্রামণ থেকে রক্ষায় গত ৭ এপ্রিল থেকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন।

এ সময় টাঙ্গাইলের ওপর দিয়ে অন্য জেলার যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ থাকে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় প্রশাসন ও পুলিশের তৎপর ছিল।

তবে কয়েক দিন ধরে জেলা ও উপজেলার সব প্রবেশপথে চেকপোস্ট থাকলেও সেখান দিয়ে মানুষজন ঢুকছে। যারা পুলিশ ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছে তাদের তথ্য দিলেও প্রশাসনের কোনো হেলদোল দেখছেন না বলে উৎকণ্ঠিতদের অভিযোগ।

উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ স্পটে গিয়ে একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

একাধিক ব্যক্তি জানান, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সামাজিক দূরত্ব, জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রথম দিকে পুলিশের ভূমিকা থাকলেও এখন তা তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। এতে করে গত কয়েক দিন ধরে পাড়া-মহল্লায় লোক সমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে করোনাভাইরাসভাইরাসের ঝুঁকি বাড়ছে।

টাঙ্গাইল সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ওয়াহীদুজ্জামান বলেন, “আমাদের প্রায় রোগীই ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জন এ তিন জেলা ফেরত। তাই এ তিন জেলা থেকে যারা আসছেন, তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।

টেস্ট করে আক্রান্তদের সাথে সাথে হাসপাতালে পাঠানো এবং বাড়ি লকডাউন করে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

তবে জেলার ধনবাড়ীতে মানুষজনের সামাজিক দূরত্ব আর লকডাউন না মানার অভিযোগ অস্বীকার করে এ উপজেলার নির্বাহী অফিসার আরিফা সিদ্দিকা বলেন, “উপজেলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মানুষদের সচেতন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সেই সাথে প্রতিটি মানুষ সচেতন হলেই এটা পুরোপুরি সম্ভব।”

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম আনোয়ার বলেন, “লকডাউনের শুরু থেকে রোববার পর্যন্ত অন্তত ৫শ’ মানুষ শুধু আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা এসেছে-যারা বিদেশে বা অন্য জেলায় কাজ করেন।

“খবর পাওয়া মাত্র তাদের বাড়ি প্রশাসনসহ আমরা তাদের বাড়ি লকডাউন করেছি।”

কালিহাতীতে ‘অবাধেবহিরাগতরা ঢুকছে’ আর ‘রাতের আঁধারে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জন থেকে বাড়ি ফেরতদের ব্যাপারে ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আরা নিপাও।

তিনি বলেন, “অতি উৎসাহী ও অমানবিক হয়ে যারা বহিরাগতের প্রবেশের তথ্য আমাদের দিচ্ছেন, তাদের অভিযোগ আমরা ওই সব বহিরাগতদের ব্যাপারে মানবিক হয়ে তদারকি করছি।

“আমাদের অলস সময় পার করার অভিযোগটি মিথ্যে।”

রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত সরকারি হিসেবে দেশে সংখ্যা সাড়ে নয় হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। এর মধ্যে ঢাকাতে সাড়ে চার হাজারের, নারায়ণগঞ্জে হাজারের ও গাজীপুরে সোয়া তিনশ আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সীমান্ত ঘেঁষা জেলা মুন্সীগঞ্জে ১২৬ ও নরসিংদীতে ১৫২ জন শনাক্ত হয়েছে। আর গাজীপুর ও নরসিংদীর গা ঘেঁষে থাকা কিশোরগঞ্জে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়েছে। সে তুলনায় টাঙ্গাইলে আক্রান্ত ২৯ জন এবং তিন জনের মৃত্যু খবর দিয়েছে আইইডিসিআর।

দেশের সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকিতে থাকা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহ জেলাগুলো মানচিত্রে পরস্পর পাশাপাশি। এ অঞ্চলের লাগোয়া জেলা টাঙ্গাইল। ফলে তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকলেও টাঙ্গাইলবাসীর মাঝে বিরাজ করছে আতঙ্ক।

ঢাক ও উত্তরবঙ্গের মধ্যে প্রবেশপথ এলেঙ্গা। এ পথেই ‘প্রতিদিন মিছিলের মতো’ মানুষ রাত থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত পারাপার হচ্ছে। তারা যানবাহন পরিবর্তন করতে বিরতির যায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড। তাই ‘এলেঙ্গা অরক্ষিত’ বলে মনে করছেন এলেঙ্গা পৌর সভার মেয়র নূর-এ-আলম সিদ্দিকী।

জেলার ঘাটাইল উপজেলার যুবক আশিক জানান, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কর্মরত তার উপজেলার অনেক বাসিন্দা গোপনে রাতে রাতে ঢুকছে এ উপজেলায়।

এদিকে, আক্রান্তের খবর পাওয়া মাত্রই ‘পুলিশ প্রশাসন করোনা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে’ বলছেন টাঙ্গাইলে পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায়।

রোববার আইইডিসিআর ঘোষিত সব তথ্য টাঙ্গাইল সিভিল সার্জন অফিসে এনে পৌঁছেনি। জেলার কর্মকর্তারা বলছেন বাকি তিন জন জেলা বাসিন্দা হলেও নমুনা এখান থেকে না পাঠানোয় জেলায় তথ্য আসেনি।

ফলে এ অফিসে থাকা এদের মধ্যে ২৬ জন আক্রান্তর তথ্যর ভিত্তিতে এ জেলার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি তুলে ধরেন এ অফিসের মেডিকেল ও রোগ নিয়ন্ত্রণ অফিসার মুহম্মদ আজিজুল হক জানান, রোববার পর্যন্ত এ জেলার এক হাজার ৮৪৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকা ও ময়মনসিংহে পাঠানো হয়েছে। এ পর্যন্ত এক হাজার ৭২৫ জনের নমুনার রিপোর্ট পেয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এদের মধ্যে ২৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

তারা জেলার সখিপুরের ৬ জন, ভূঞাপুরের ৬ জন, নাগরপুরের ৫ জন, মির্জাপুরের ৩ জন, গোপালপুরের ২ জন এবং ঘাটাইল, মধুপুর, টাঙ্গাইল সদর ও দেলদুয়ারে একজন করে বসবাস করে।

এ ২৬ জনের মধ্যে ঘাটাইলের ও মির্জাপুরের কজন করে দুইজন মারা গেছেন, আর সুস্থ হয়েছে মির্জাপুর, নাগরপুর ও ভূঞাপুরে মোট সাত ব্যক্তি।

টাঙ্গাইল জেলা সিভিল সার্জন অফিসের কাছে থাকা তথ্য-২৬ জনের মধ্যে ঢাকা ফেরত থেকে সংক্রমিত ১৭ জন, নারায়ণগঞ্জ ফেরত ২, গাজীপুর ফেরত ৩, রাজবাড়ি ফেরিঘাট থেকে একজন এবং টাঙ্গাইল সদরের এক চিকিৎসক সংক্রমিত হন। বাকি দুইজন জেলার ভেতরে থেকেই আক্রান্ত হন।

জেলার প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি মির্জাপুরের বাসিন্দা নারায়ণগঞ্জে এক বেসরকারি ক্লিনিকে চাকরি করতেন-চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন তিনি। নাগরপুরের সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তি ঢাকার সদরঘাটে শ্রমিকের কাজ করেন। এছাড়া ভূঞাপুরের আক্রান্ত ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জে এক গার্মেন্টসে কাজ করতেন।

ভূঞাপুরের চারজন এবং নাগরপুরের তিনজন ঢাকায় এক ওষুধ কোম্পানিতে চাকরিরত অবস্থায় সংক্রমিত হন। এদের একজন সুস্থ হয়েছেন, বাকিরা চিকিৎসাধীন।

এদিকে, সখিপুরে একই পরিবারের পাঁচজন আক্রান্ত হন। পরিবারের কর্তা ঢাকার কারওয়ান বাজারে সবজি বিক্রি করেন। তিনি আক্রান্ত হয়ে বাড়ি এলে তার স্ত্রী ও তিন ছেলে সংক্রমিত হয়।

এছাড়াও সখিপুরের আ্যাম্বুলেন্স এক চালক ঢাকায় রোগী আনা-নেওয়া করতে গিয়ে আক্রান্ত হন।

মির্জাপুরের শুক্রবার আক্রান্ত দুইজন ঢাকা ফেরত। এদের মধ্যে এক যুবক ঢাকায় সোনার গহনার দোকানে কাজ করতেন। আর মারা যাওয়া নারী তার বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে আক্রান্ত হন। এ  দুজনের মধ্যেই হালকা কাশি ছাড়া করোনাভাইরাসের তেমন কোনো লক্ষণ ছিল না বলে তথ্য রয়েছে।

কোভিড-১৯ রোগে এ জেলার প্রথম মারা যাওয়া ঘাটাইলের বাসিন্দা ঢাকার এক হাসপাতালে কিডনি রোগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আক্রান্ত হন। তাকে ঢাকায় দাফন করা হয়।

মধুপুর ও গোপালপুরের দুইজন গাজীপুরের গার্মেন্টেস শ্রমিক। এছাড়া ভূঞাপুরের এক ওয়ার্কশপ কর্মী গাজীপুর থেকে আক্রান্ত হন; যিনি উপজেলার অলোয়া ইউনিয়নের চরনিকলা গ্রামের বাসিন্দা।

ফলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলা থেকে কেউ এলাকায় ঢুকলেই সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। বাড়ি ফেরতরা কেউ কেউ হোম কোয়ারেন্টিনে না থেকে স্বাভাবিক চলাফেরা করার চেষ্টা করছেন বলেও এলাকার লোকজনের অভিযোগ।

এ বিষয়ে, টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম জানান, টাঙ্গাইল জেলাকে আগেই লকডাউন করা হয়েছে।

“যেহেতু আমাদের প্রায় আক্রান্তই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর ফেরত ব্যক্তি। তাই এ তিন জেলার লোক যেন টাঙ্গাইলে ঢুকতে না পারে সেজন্য চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।

“তবু তারা গোপনে রাতে রাতে বিভিন্নভাবে চলে আসছে। এদের ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছি।”

একই সাথে জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে প্রশাসন বলেও জানান এ জেলা প্রশাসক।