বালুমহালের ইজারা বন্ধ ১০ বছর, বন্ধ নেই উত্তোলন

কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর বালুমহালের উপর একের পর এক মামলা ফেঁদে দশ বছর ধরে ইজারা বন্ধ রেখেছে একটি গোষ্ঠী। তবে ইজারা বন্ধ থাকলেও বন্ধ হয়নি বালু উত্তোলন। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

হাসান আলী কুষ্টিয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2020, 04:09 AM
Updated : 22 Jan 2020, 04:36 AM

গত দশ বছরে সরকার অন্তত দুইশ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে বলছে রাজস্ব বিভাগ।

নির্মাণ কাজে কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর বালুর সুখ্যাতি রয়েছে। জেলার ২১টি বালুমহাল থেকে দিনে অন্তত পাঁচ লাখ ঘনফুট মোটা বালু তোলা হয়। এসব বালু যাচ্ছে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায়।

কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ওবাইদুর রহমান জানান, ২১টি বালুমহালে আইনগত জটিলতা থাকায় ১০ বছরে দেড় থেকে ২শ কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।

মিরপুর উপজেলার রানাখড়িয়া বালুঘাটের ব্যবসায়ী ওহিদুল কবিরাজ বলেন, পশ্চিম বাহিরচর ও রানাখড়িয়া-তালবাড়িয়া বালু ঘাটে পদ্মা নদী থেকে প্রতিদিন নির্মাণ কাজের সর্বোচ্চ মান সম্মত প্রায় পাঁচ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন ও সরবরাহ হচ্ছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা।

উচ্চ আদালত থেকে মামলার জটিলতা নিরসনে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এরইমধ্যে আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “উচ্চ আদালত থেকে আইনি লড়াই করে যখনই কোন বালুমহাল ভ্যাকেট [অকার্যকর] করা হয়, তখনই আবার নতুনভাবে রিট পিটিশন করে দিনের পর দিন এ জটিলতা সৃষ্টি করে চলেছে একটি মহল।”
উচ্চ আদালতের এসব মামলা পরিচালনায় ভূমি মন্ত্রণালয় নিযুক্ত কৌঁশুলি মোসাম্মৎ মোরশেদা পারভিন বলেন, আনোয়ারুল হক মাসুম নামের এক ব্যক্তি ২০১০ সালে কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি উপজেলার ২১টি বালুমহালের মধ্যে ১১টি মৌজার বালুমহালের উপর রিট পিটিশন করে এ জটিলতা শুরু করেন। এরপর ক্রমানুসারে ২০১১, ১২, ১৩, ১৪, ও ২০১৫ সালে সব কয়টি বালুমহালের উপর মামলা হয়।

“রাষ্ট্রের পক্ষে এসব মামলা মোকাবিলা করে ৮টি মামলা আমরা ভ্যাকেট করলেও, পুনরায় ২০১৯ সালে মামলার বাদী রিট পিটিশন করেন; যা এখনও বিচারাধীন।”

অধিকাংশ মামলার রিট অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি জানান, এসব বালু মহালে সরকার চাইলে নিজেদের অনুকূলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

ভলগেট নৌকা মালিক সাহাবুল ইসলামের অভিযোগ, সরকারিভাবে বালুমহাল ইজারা কার্যক্রম বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে জোরপূর্বক প্রতিদিন কেবলমাত্র বাহিরচর বারোমাইল ও ঘোড়ামারা তালবাড়িয়া বালুঘাটের অন্তত ৫শ নৌকা থেকে গড়ে ৫০ লাখ টাকা বিনা রশিদে চাঁদা আদায় করছেন প্রভাবশালী ঘাট মালিকারা।

“এতে চরম নিপীড়নের শিকার হচ্ছি আমরা।

“এসব বিষয়ে মুখ খোলা যাবে না। ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস ও পুলিশ সবাই জানে এখানে কী হচ্ছে। প্রশাসন পদক্ষেপ নিয়ে বৈধভাবে ইজারা দিলে সরকারি রাজস্ব পেত, আবার রেট বেঁধে দিলে আমরাও নির্ধারিত টোল দিয়ে ব্যবসা করতে পারতাম।”

ঘোড়ামারা-তালবাড়িয়া-রানাখড়িয়া বালুঘাট মালিক ইউপি চেয়ারম্যান হান্নান মন্ডল বলেন, “কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন থেকে চার কোটি টাকা দিয়ে আমি যুগিয়া-তালবাড়িয়া ‘ধুলটমহাল’ ইজারা নিয়ে ‘বালুমহালের’ টোল আদায় করছি।”

এ সময় ধুলট মহলের ইজারাদার বালুমহালের টোল নিচ্ছেন কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বিধিসম্মত ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন। তবে প্রশাসনের সাথে যোগসাজসের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।

প্রশাসন নির্ধারিত বালুমহালের বাইরে নদীতে জেগে ওঠা বালুচরকে ‘ধুলটমহাল’ বলে। এসব চরও বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেওয়া হয়।

বিআইডব্লিউটিএ অনুমোদিত ইজারাদার দাবিদার ভেড়ামারা পশ্চিম বাহিরচর ও বারোমাইল বালুঘাটের টোল আদায়কারী মেসার্স ব্লেজ ইন ট্রেড এর স্বত্ত্বাধিকার আতিকুজ্জামান বিটু বলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত নৌ-যান চলাচলের টোল আদায়কারী হিসেবে সরকারি রাজস্ব ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়েই বাহিরমহালের টোল তুলছি।

আইনগত জটিলতা বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা টাকা পয়সা সব দেওয়ার পরও নৌ-মন্ত্রণালয় দাবি করে এটা তাদের; আবার ভূমি মন্ত্রণালয় দাবি করে এটা তাদের। এখানে আমরা নিরুপায় হয়ে হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দিলাম।”

বালুমহালের ইজারা বন্ধ থাকলেও সেখান থেকে টোল তুলছেন এমন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, “এখানে যা কিছু হচ্ছে তার সব সবাইকে ম্যানেজ করেই হচ্ছে।”

সংগৃহীত টাকার ভাগ জেলা, উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে দেন বলেও দাবি করেন তিনি।

এই ২১টি বালুমহালকে মামলা জটিলতায় আটকে রাখার অভিযোগে থাকা আনোয়ারুল হক মাসুমের লেটারহেড প্যাডে ব্যবহৃত ঠিকানার সরেজমিন কোনো অস্তিত্ব কুষ্টিয়া পৌর এলাকায় নেই বলে নিশ্চিত করেন ৬ নম্বর পৌর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বদরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “এই নাম ঠিকানা ভুয়া এবং অস্তিত্বহীন।” 

কুষ্টিয়ার সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) এএসএম আকতারুজ্জামান মাসুম বলেন, ১০ বছর ধরে অস্তিত্বহীন ঠিকানার মামলাবাজ আনোয়ারুল হক মাসুম রিট পিটিশন করে বালুমহালের ইজারা কার্যক্রম বন্ধ রেখে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার কোটি টাকা। সেই সাথে অদ্যবধি হিসাব মতে অন্তত সরকারের ২শ কোটি টাকার রাজস্ব গায়েব করে দিয়েছেন।
কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মহসিন এবং সনাক কুষ্টিয়ার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম টুকু অভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, “সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কীভাবে এটা মেনে নিচ্ছেন তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। এতে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে যে সৃষ্ট এই আইনি জটিলতা জিইয়ে রাখায় প্রশাসনের কারো কারো যোগসাজস থাকতে পারে।”
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, “এটুকু বলছি যে, দীর্ঘদিন ধরে মামলা জটিলতায় এসব বালুমহালে বিদ্যমান পরিস্থিতি নিরসন করে খুব শীঘ্রই আমরা সরকারি রাজস্ব আয় নিশ্চিত করতে পারব। সেভাবেই আমরা এগুচ্ছি।”
তবে ইজারা বন্ধ থাকার পরও কীভাবে এবং কারা বালু উত্তোলন করছে তা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।