খুলনায় ৬১ কোটি টাকায় গড়া রেলস্টেশনে নেই যাত্রীসেবা

আধুনিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যে নির্মিত খুলনার নতুন রেলওয়ে স্টেশন চালুর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও যাত্রী সেবা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুভ্র শচীন খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2019, 04:58 AM
Updated : 8 Dec 2019, 04:58 AM

৬১ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে নির্মিত এ স্টেশনে প্রায় অর্ধেক পদে লোক না থাকায় কাক্ষিত যাত্রীসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে অকপটে স্বীকার করেছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।

আধুনিক যাত্রীসেবা পাওয়ার আশায় খুলনাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে নির্মিত নতুন স্টেশনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন ২০১৮ সালের ৩ মার্চ। তার আগের বছরের ২৫ নভেম্বর থেকেই এ স্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়- ট্রেন চলাচল শুরুর দুই বছর পেরিয়ে যাওয়া এ স্টেশনে ছয়টি টিকিট কাউন্টার, তিনটি বিশ্রামাগার, ক্যান্টিন, কিচেন রুম, ব্যাংক বুথ, নতুন প্লাটফর্ম, পার্কিং সুবিধা, স্টেশন মাস্টার-কর্মকর্তাদের পৃথক কক্ষসহ নানা ব্যবস্থা থাকলেও এখনো চালুই হয়নি অনেক কিছু।

বছরে ৩০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয়ের এ স্টেশনে যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত তোষক, কম্বল, বেডশিট ও বালিশসহ বেডিং সামগ্রী রাখার কোনো কক্ষ নেই। এসব তোষক-কম্বল বিশ্রামাগারসহ বিভিন্ন জায়গায় রাখতে দেখা যায়।

বছরে ১০ লাখের বেশি যাত্রী যাতায়াতের এ স্টেশনে অনুসন্ধান কেন্দ্র এবং নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা নেই। সন্ধ্যার পর দুই কিলোমিটার দীর্ঘ প্লাটফর্মের মধ্যে আনুমানিক দেড় কিলোমিটার এলাকায় আলোর ব্যবস্থা চোখে পড়ে না।

স্টেশনে খাবার পানির সংকট এবং ক্যান্টিন না থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের অভিযোগ।

প্রয়োজনীয় সেবা না থাকায় আশাহত বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফ উজ জামান বলেন, “এমন কি গরমের দিনে ফ্যানবিহীন কাউন্টারে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট নিতে হচ্ছে।”

মশিউর রহমান জাদু নামের এক যাত্রীর অভিযোগ, ‘স্টেশনের বিশ্রামাগার সকালের বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। এখানে আসার পর লাগেজ, ব্যাগসহ পরিবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।’

“বিশ্রামাগারের টয়লেটগুলো থেকে ব্যাপক দুর্গন্ধ ছড়ায়।”

নগরীর বয়রা এলাকার বাসিন্দা সাদিয়া ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, ‘টিকিট কাউন্টার রয়েছে ছয়টি কিন্তু সন্ধ্যায় চালু থাকে মাত্র দুটি। মহিলা কাউন্টার থাকলেও সেটা বন্ধ থাকছে।

টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রী আমিনুর রহমানের অভিযোগ, “অনেকে লাইন ভেঙে টিকিট নেন। এ ব্যাপারে স্টেশনমাস্টারকে বললেও কোনো কাজ হয় না।”

মালামাল পরিবহনে কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় হওয়া এ স্টেশনে পার্সেল-গুডস গোডাউন এবং পার্কিং-এ নিরাপত্তাকর্মী না থাকায় মালামাল চুরি হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

খুলনার বড় বাজারের ব্যবসায়ী শ্যামা প্রসাদ সাহা বলেন, “মালামাল রাখার জন্য নতুন স্টেশনে কোনো ব্যবস্থা নেই। পুরোনো রেলস্টেশনের গুদাম ব্যবহার করায় ব্যবসায়ীদের অসুবিধা পোহাতে হচ্ছে।”

“অথচ রেলে মালামাল পরিবহন করে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব আয় করছে।”

যাত্রী নাজমুল হক লাকী বলেন, ‘স্টেশনের সামনে পার্কিং-স্থানে গাড়ির জট লেগেই থাকে। যে কারণে লাগেজ নামাতে যাত্রীদের বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

যাত্রীসেবা দিতে ব্যর্থতার সব অভিযোগ মেনে নিয়ে এর কারণ ব্যাখ্যায় লোকবল সংকটের চিত্র তুলে ধরেন খুলনা রেল স্টেশন মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকার।

তিনি জানান, বাণিজ্যিক বিভাগের ৪৮টি পদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন ২০ জন। পরিবহন বিভাগে ৭৫ জন থাকার কথা থাকলেও কমর্রত রয়েছেন ৬২ জন।

ছয়টি কাউন্টার চালু রাখতে ১৮ জন কর্মী দরকার উল্লেখ করে তিনি জানান, সেখানে প্রধান বুকিং সহকারীসহ রয়েছেন মাত্র সাত জন।

“এ কারণে তিনটি কাউন্টার খোলা রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি কাউন্টার আবার ভারতগামী যাত্রীদের জন্য রয়েছে।”

তিনজন কর্মী দিয়ে বিশ্রামাগারের কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়া সম্ভব নয়  উল্লেখ করে অন্তত আরো তিনজন কর্মী প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

“জনবল সংকটের কারণে অনেক সময় দেরিতে বিশ্রামাগার খুলতে হচ্ছে।”

নতুন স্টেশনের গাড়ির দিক পরিবর্তন করার ২৬টি পয়েন্টে রয়েছে ১৫ জন পয়েন্টসম্যান। সেখানেও আরও অন্তত ১১ জন প্রয়োজন।

“এ স্টেশনে সব মিলিয়ে ১২৩ পদের মধ্যে ৪১টি পদই খালি রয়েছে।”

স্টেশনের এসব সমস্যার কথা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে জানানোর কথাও বলেন তিনি।

এ স্টেশন থেকে প্রতিদিন ১০টি ট্রেন চলাচলের কথা পেড়ে যাত্রী ও মালাপত্র আনা-নেওয়ার হিসেব দেন রেলওয়ের ট্রাফিক কর্মকর্তা অংশুমান রায় চৌধুরী।

অংশুমান জানান, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খুলনা থেকে বিভিন্ন রুটে যাত্রী চলাচল করে ১০ লাখ ৯ হাজার ৫৫০ জন। সে বছর এ খাত থেকে আয় হয় ৩০ কোটি ৪৭ লাখ ৫১ হাজার ৯৮৪ টাকা।

এছাড়া মালামাল বহন করে একই সময়ে এক কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার ৬২৯ টাকা আয় হয় বলেও জানান তিনি।

প্রথমে ৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮ মাসে নির্মাণের লক্ষ নিয়ে ২০১৫ সালের এপ্রিলে নতুন স্টেশনের কাজ শুরু হয় বলে জানালেন রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার মো. হাফিজুর রহমান।

“কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সময় বৃদ্ধির কারণে নির্মাণ ব্যয় ৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।”

এক সপ্তাহ আগেও খুলনা থেকে ঢাকাগামী যাত্রীরা টিকিট না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ খুলনা উন্নয়ন ফোরামের চেয়ারম্যান শফিকুল হামিদ চন্দন বলেন, খুলনা রেলস্টেশনের কর্মকর্তারা দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত।

আশার বাণী শোনাতে গিয়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের জিএম খন্দকার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব অবকাঠামোগত সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তা আমাদের প্রকল্পের মধ্যে আছে। সব সমস্যা আস্তে আস্তে সমাধান করা হবে।’

তবে কবে নাগাদ এসব সমস্যার সমাধান হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেননি তিনি।