আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষায় ‘দেশের ১ নম্বর মাদক চোরাকারবারি’ সাইফুল করিম যাদের ইয়াবার কারবার দেখভাল করতেন, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির দুই ভাই ও এক ফুফাতো ভাইয়ের নামও রয়েছে।
Published : 10 Jun 2019, 05:14 PM
‘দেশের ১ নম্বর মাদক চোরাকারবারি’ সাইফুল কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত
পুলিশ বলছে,সপ্তাহ দুই আগে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে সাইফুল জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি স্বীকার করে গেছেন।
‘বন্দুকযুদ্ধের’ ওই ঘটনায় টেকনাফ মডেল থানার এসআই রাসেল আহমদ ৩৩ জনকে আসামি করে তিনটি মামলা করেন।
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাইফুল করিম মৃত্যুর আগে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কয়েকটি ইয়াবা ও হুন্ডি চক্রের ৩৩ জনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তাদের সবাইকে সাইফুল করিম হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে।”
এই ৩৩ জনের মধ্যে ১৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম ও পরিচয় এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৫ জনকে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এজাহারে বদির দুই ভাই ও এক ফুফাতো ভাইয়ের ইয়াবার কারবারের প্রসঙ্গ এলেও তাদের আসামি করা হয়নি। আসামির তালিকায় নাম এসেছে কেবল বদির ভাগনে মো. ফারুকের।
মামলার নথিতে বলা হয়েছে,পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল করিম স্বীকার করেন যে মিয়ানমার থেকে আমদানি পণ্যের ভেতরে লুকিয়ে বাংলাদেশে প্রথম ইয়াবা ট্যাবলেট তিনেই নিয়ে আসেন। তখন থেকেই তিনি টেকনাফসহ সারাদেশে ইয়াবার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন।
“সে (সাইফুল করিম) আরও জানায় যে জালিয়াপাড়া ঘাট এলাকার মো. আমিন, মৌলভী মুজিব, সালমান, টিটি জাফরের (জাফর আলম) ভাই গফুর, এমপি বদির ভাই শুক্কুর, শওকত ও রাসেল গংদের ইয়াবা ব্যসা সে নিজেই পরিচালনা করত।“
এদের মধ্যে টেকনাফের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা বদির ভাই মুজিবুর রহমান ওরফে মৌলভী মুজিব পলাতক বলে পুলিশের ভাষ্য।
বদির আরেক ভাই আব্দুর শুক্কুর এবং ফুপাত ভাই কামরুল হাসান রাসেল গত ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সাংসদ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুর রহমান বদিকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। বদির আসনের বর্তমান সাংসদ তার স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরীর বক্তব্যও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বদির বদলে তার স্ত্রীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের পর দুই মাসের মধ্যে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন ১০২ জন ইয়াবা কারবারি। তাদের মধ্যে বদির চার ভাইসহ আটজন আত্মীয়ও ছিলেন।
পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে ইয়াবার প্রথম চালান দেশে এনেছিলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের শিলবুনিয়া পাড়ার ডা. মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাইফুল করিম। মাদকের কারবারে রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠা সাইফুল কক্সবাজার জেলা থেকে সর্বোচ্চ কর দিয়ে সিআইপি মর্যাদাও পেয়েছিলেন।
টেকনাফ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানার অস্ত্র ও মাদক আইনের সাতটি মামলার পলাতক আসামি সাইফুলকে গত ৩০ মে গ্রেপ্তার করে টেকনাফের পুলিশ। পরে থানায় নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
পরে সাইফুলকে সঙ্গে নিয়ে গভীর রাতে ‘ইয়াবা উদ্ধার অভিযানে’ বের হয় পুলিশের একটি দল। পরে টেকনাফ স্থলবন্দরের সীমানাপ্রাচীরের কাছে মাদক চোরাকারবারিদের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সাইফুলের নিহত হওয়ার খবর জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
এর আগে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মোট ৬৭ জনের নাম প্রকাশ করে গেছেন সাইফুল; সেখানে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নামও এসেছে।
কিন্তু পুলিশের করা মামলার এজাহারে কোনো পুলিশের কর্মকর্তা বা সাংবাদিকের নাম নেই। সেখানে সাইফুলের ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসার অন্যতম সহযোগী হিসেবে জাফর আলম ওরফে টিটি জাফরের কথা বলা হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, “টিটি জাফরের মাধ্যমে হুন্ডির টাকায় বাংলাদেশে ইয়াবার চালান আনা হতো এবং সিন্ডিকেটের সহযোগীদের মাধ্যমে সেই ইয়াবার চালান সারাদেশে পাচার করা হতো।”
এ মামলার আসামির তালিকায় নাম থাকা ‘ইয়াবা কারবারিরা’ হলেন- টেকনাফ পৌরসভার জালিয়া পাড়ার জাফর আহমদ ওরফে টিটি জাফর, অলিয়াবাদ গ্রামের ছৈয়দ আলম ওরফে সোনা মিয়া, পুরান পল্লান পাড়ার মো. ফারুক (বদির ভাগনে)), ডেইলপাড়ার মো. আমিন, শীলবুনিয়া পাড়ার নুর হাছন, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার আমির আলী ওরফে বর্মাইয়া আলী, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বড় হাবির পাড়ার মো. আলী আহম্মদ,শীলবুনিয়া পাড়ার মো. আয়াছ ওরফে বর্মাইয়া আয়াছ, তার ছোট ভাই মো. ইয়াছের ওরফে বার্মাইয়া ইয়াছের, শীলবুনিয়া পাড়ার মো. দেলোয়ার, কেরুণতলী এলাকার মো. মিজান এবং লেঙ্গুরবিলের জাফর চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে মো. কাদের।
এছাড়া অলিয়াবাদ গ্রামের রবিউল আলম, শীলবুনিয়াপাড়ার মো. শফিক, মো. শামসু, উত্তর লম্বরীর মো. শামসু, মধ্য জালিয়াপাড়ার মো. মনিরুজ্জামান ওরফে আমির সাব এবং নিহত সাইফুল করিমের ভাগ্নে মো. মিজানের নাম রয়েছে ১৮ জনের মধ্যে।
এজাহারে বলা হয়েছে, “সাইফুল টেকনাফ স্থলবন্দরের বৈধ ব্যবসার আড়ালে উপরে উল্লেখিত আসামিদের মাধ্যমে ইয়াবা কারবার পরিচালনা করত। মিয়ানমারের মংডু শহর থেকে ইয়াবার চালান টেকনাফ এনে সারাদেশে পাচার করত। মামলার আসামিরা যৌথ মূলধন বিনিয়োগ করে ইয়াবা পাচারের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি কিনতো, যাতে ব্যবসা অন্য সিন্ডিকেটের লোকজনের কাছে হাতছাড়া হয়ে না পড়ে।”
ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, “মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ নানাভাবে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”