মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থানের কথা বলা হলেও ক্ষমতাসীন দলের এক সাংসদ দেশে ইয়াবা ঢোকার মূল রুটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন বলে সরকারি এক তালিকায় উঠে এসেছে।
Published : 05 May 2014, 05:40 PM
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ওই তালিকায় বলা হয়েছে, কক্সবাজার-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ছত্রছায়ায় আরো অনেকে ইয়াবা ব্যবসা করছেন।
ভাই-বেয়াই, মামা-ভাগ্নে মিলিয়ে বদিসহ ১০ জন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বলে তালিকায় বলা হয়েছে।
ওই তালিকা ধরে অভিযান চালানো শুরু হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, প্রভাবশালী কাউকেই ছাড় না দিতে সরকারের উপর মহলের নির্দেশ রয়েছে। আর সে অনুযায়ী কাজ করছেন তারা।
তবে মাঠ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার মতে ‘বড় গাছ কাটার আগে তার ডাল-পালা ছেঁটে ফেলতে হয়। তারপর গাছের গোড়ায় কোপ দিতে হয়।’
ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নির্মূলে কক্সবাজারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তার এ কথার ‘সত্যতা’ পাওয়া যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে।
গত রোববার র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক সহযোগীসহ নিহত হন টেকনাফ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জাহেদ হোসেন জাকু, যিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। ইয়াবা পাচারকালে অভিযান চালালে ওই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে কর্মকর্তারা জানান।
নিহত জাকু সাংসদ বদির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে এলাকাবাসী জানান।
বাংলাদেশে ইয়াবা মূলত প্রবেশ করে কক্সবাজার জেলা দিয়ে। বিজিবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলার অন্তত ৪৫টি রুট দিয়ে ইয়াবা আসে।
সম্প্রতি মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বলা হয়েছে এক হাজার ২০০ জনের বেশি। দুই বছর আগের তালিকায় ছিল ৫৫৪ জন।
গত ২৩ জানুয়ারি অধিদপ্তরের অপারেশন অধিশাখার প্রকাশ করা ওই প্রতিবেদন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে এসেছে।
এতে কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আব্দুর রহমান বদি, তার আপন দুই ভাই ও দুই সৎ ভাই রয়েছেন। রয়েছেন তার অনেক ‘অনুসারী’।
ওই তালিকায় বদির আপন ভাই মো. আব্দুল শুক্কুর, মৌলভী মুজিবুর রহমান, দুই সৎ ভাই আবদুল আমিন ও ফয়সাল রহমানের নাম এসেছে। এর বাইরে বদির বেয়াই আখতার কামাল, শাহেদ কামাল, মামা হায়দার আলী, মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল এবং ভাগ্নে নীপুরও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তালিকায় নিজের এবং আত্মীয় স্বজনের নাম থাকার বিষয়ে সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি গত ২৮ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তালিকায় নাম থাকার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। মনে হয় কোনো ভুল হয়েছে।
“আমি দুইবার নির্বাচিত এমপি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াবার বিরুদ্ধে। আমিও বিরুদ্ধে, ইয়াবা নির্মূল আমিও চাই।”
স্থানীয় কিছু সাংবাদিক বিএনপি-জামায়াতের টাকা খেয়ে তার সম্মানহানির চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন বদি।
বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন বলেও জানান তিনি।
তবে রোববার টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি হার্টের অসুখে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি। আমি অসুস্থ।”
এরপর আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের মূল টার্গেটের একজন এমপি বদি। এ কারণে আমরা আগে তার সহযোগীদের ধরা শুরু করেছি। এতেই সে দুর্বল হয়ে পড়বে।
“ওপরের নির্দেশ এলে তার বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হবে।”
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) প্রণব কুমার নিয়োগী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তাদের প্রতিবেদনের বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য না করে বলেন, “সরকার যখন মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করবে, তখন সবার বিরুদ্ধেই করবে।
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব এজেন্সির সমন্বয়ে তালিকা তৈরি করে মাঠে নেমেছে। ওখানে শুধু আমাদের না, অন্যান্য এজেন্সির তালিকাও আছে। এখানে কারো নাম থাকা, না থাকার ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না। তবে একটা বিষয়, মাদক পাচারকারী যে দলেরই হোক না কেন কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না।”
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবুজার আল জাহিদ বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এলাকা ভিত্তিক ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটা তালিকা আমরা পেয়েছি। সে অনুযায়ী অভিযান চলছে।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইয়াবা নির্মূলের নির্দেশ দিয়েছেন। যত প্রভাবশালীই হোক না কেন কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।”
আব্দুর রহমান বদির নাম ওই তালিকায় আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তালিকাটা গোপনীয়। কারো নাম থাকার বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। যাদের নামই থাকুক না কেন সবার বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।”