ঈদের আনন্দের মধ্যেও স্বদেশে ফেরার আকুতি ধরা পড়ে তাদের অভিব্যক্তিতে। তারা সম্মানজনক নাগরিকের মর্যদা নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে যায়। স্বজনদের হত্যার বিচার চায়। এর মধে্যে তারা বাংলাদেশে কয়েকটি ঈদ পালন করেছে। বরাবরের মতো এবারও তারা স্বদেশে ফেরার আকুতি প্রকাশ করেছে।
প্রবাসে কষ্টের জীবনেও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের ঈদে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। নতুন জামা-কাপড় পরে ঘোরাঘুরি আর স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ছাড়াও দুরন্তপনা ও হই-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে তারা।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে শুরু হওয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতার জেরে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। পরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদের ঠাঁই হয়।
এর আগে বিভিন্ন সময় পালিয়ে আসা আরও চার লাখসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম এদেশে বসবাস করছে। উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাদের ৩৩টি ক্যাম্প রয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্যাম্পের মসজিদগুলোতেই ঈদ জামাতের আয়োজন করা হয়। নতুন পোশাকে রোহিঙ্গারা নামাজ আদায় করে।
নির্যাতন আর সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হওয়া স্বজনদের জন্য দোয়া করতে গিয়ে নামাজে আসা অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কেউ কেউ কান্না করে স্বদেশে সম্মানজনক নাগরিক অধিকার নিয়ে ফিরে যাবার আকুতি জানাচ্ছিলেন। তারা নির্যাতন আর নিপীড়নকারীদের বিচার চেয়ে দোয়া করেছেন। নামাজ শেষে পরস্পর কোলাকুলির সময়ও কাউকে কাউকে কাঁদতে দেখা গেছে।
ক্যাম্পের সড়ক-উপসড়ক আর অলিগলিগুলোতে ছিল রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের আনাগোনা ও হৈ-হল্লোড়। তাদের গায়ে নতুন জামা-কাপড়, কারও কারও হাতে প্লাস্টিকের তৈরি ঘড়ি, চোখে চশমা আর মাথায় হরেক রকমের রঙিন টুপি। মেয়েদেরও সাজে কমতি ছিল না। তারা কানে দুল, গলায় মালা, চোখে চশমা আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে ঈদের সাজ নিয়েছে।
ঈদের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্প-১ এর বাসিন্দা ছৈয়দ আলম (৩০) বলেন, সহিংসতার সময় চোখের সামনেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে তার বাবা ও এক বড়ো ভাইকে খুন করে। এ দৃশ্য মনে পড়লে চোখে এখনও অন্ধকার নেমে আসে।
নামাজে তাদের জন্য দোয়া করার সময় আল্লাহর কাছে নির্যাতন ও নিপীড়নকারীদের বিচার চেয়েছেন বলেও জানান এ রোহিঙ্গা।
কথা হয় লম্বাশিয়া ক্যাম্প-৪ এর বাসিন্দা মোহাম্মদ সলিমুল্লাহর (৫৫) সঙ্গে।
সলিমুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাড়ির ভিতর থেকে বের করে এনে তার বাবা ও স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে। পরে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তিনি ও সন্তানরা পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন।
ঈদের দিনেও স্বজনদের হত্যার নির্মম দৃশ্য এখনও চোখে ভাসছে। দেশে থাকতে একসঙ্গে আনন্দে ঈদ উদযাপন করতেন। হারানো স্বজনদের জন্য খুবই মন কাঁদছে বলে জানান সলিমুল্লাহ।
নিজ দেশে শান্তি ফিরে এলে এবং সম্মানজনক নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা পাওয়া গেলে এখনই তারা স্বদেশে ফিরে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
“শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আর সম্মানজনক নাগরিক অধিকার নিয়ে স্বদেশে ফিরতে পারার স্বপ্নটাই রোহিঙ্গাদের কাছে আজ বড় ঈদে পরিণত হয়েছে,” বলেন প্রবীণ রোহিঙ্গা ছৈয়দ আকবর।
প্রাপ্তবয়স্ক আর প্রবীণদের মধ্যে বিষাদ দেখা গেলেও শিশু-কিশোররা ছিল উচ্ছল হাসিখুশি।
মধুরছড়া ক্যাম্প এলাকায় দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো কিশোরী হামিদা আক্তার (১১) বলছিল, ঈদে খুব লাগছে। নতুন জামা, জুতা, হাতের চুড়ি, গলার মালা, কানের দুল এবং হাতে লাগানোর জন্য মেহেদী কিনেছে। এসব পরে এবং সাজগোজ করে স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে বের হয়েছে।
এ সময় পাশে চোখে রঙিন চশমা ও হাতে প্লাস্টিকের ঘড়ি পরে বাঁশি বাজিয়ে হই-হুল্লোড় করছিল রোহিঙ্গা শিশু মোহাম্মদ সালাম (৯)।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ঈদ উপলক্ষে রোহিঙ্গাদের মাঝে ঈদ সামগ্রী বিতরণসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম।
আবুল কালাম বলেন, ক্যাম্পে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের মাঝে ঈদ উপলক্ষে সেমাই, চিনি, গুড় ও নারিকেলসহ নানা ঈদসামগ্রী বিতরণ করেছে। কোনো কোনো সংস্থা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি ও টুপিসহ নতুন পোশাকও বিতরণ করেছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মাঝে ঈদ উদযাপনে কর্মরত সংস্থাগুলো এ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান এ শরণার্থী কমিশনার।