বাঘাইছড়িতে নিহত মন্টুকে ঘিরে রহস্য

রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নির্বাচনী দায়িত্বপালনকারীদের সঙ্গে নিহত মন্টু চাকমা কে, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।

ফজলে এলাহী রাঙামাটি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2019, 11:47 AM
Updated : 23 March 2019, 11:47 AM

তার নাম মন্টু চাকমা বলা হলেও তিনি আসলে কে, তা প্রকাশ করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি ভোটের দায়িত্বে ছিলেন না; নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত গাড়ির চালক কিংবা সহকারীও ছিলেন না। পথচারীও ছিলেন না তিনি। ওই দিন হামলাকারী কারও মারা যাওয়ার খবরও আসেনি।

মন্টু চাকমার যে ঠিকানা পুলিশ দিচ্ছে, সেখানে খুঁজেও এই নামে কারও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় জপ্রতিনিধিরাও কিছু বলতে পারছেন না। এমনকি যার প্রত্যয়নে লাশ হস্তান্তর হয়েছে, সেই ইউপি চেয়ারম্যানও চেনেন না মন্টু চাকমাকে।

উপজেলার পরিষদ নির্বাচনে গত ১৮ মার্চ ভোট গ্রহণ শেষে সাজেকের তিনটি কেন্দ্র থেকে নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে নয়মাইল এলাকায় পাহাড়ি সড়কে হামলার মুখে পড়ে ভোটগ্রহণকর্মীরা।

হামলায় মো্ট সাতজন নিহত এবং ১১ জন আহত হন। নিহতদের দুজন পোলিং কর্মকর্তা এবং চারজন আনসার সদস্য হিসেবে নিশ্চিত করা হয়।

তখন পুলিশ বলেছিল, নিহত মন্টু চাকমা পথচারী; তার সত্যতা মিলছে না এখন।

পথচারী ‘নয়’

সাজেকের তিনটি কেন্দ্র থেকে তিনটি চাঁদের গাড়িতে সেদিন রওনা হয়েছিলেন ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা। তার পাহারায় ছিল বিজিবির একটি গাড়ি।

হামলায় বেঁচে আনা নির্বাচনকর্মীদের বর্ণনা অনুযায়ী, সেদিন সন্ধ্যার পর পাহাড়ের উপর থেকে তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিল। গাড়ির চালকরা গাড়ি না থামিয়েই চালিয়ে নিয়ে আসেন।

আক্রান্ত গাড়িবহরের শেষ গাড়িতে থাকা আনসারের প্লাটুন কমান্ডার শামসুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাঘাইহাট থেকে যাত্রা করার পর এবং গুলিতে আক্রান্ত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে কোনো গাড়ি দাঁড় করানো হয়নি।

“সে কারণে আমি নিশ্চিত নিহত মন্টু পথচারী নন। পথচারী হলে তার লাশ পথেই পড়ে থাকার কথা ছিল।”

গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে বৃহস্পতিবার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন শামসুজ্জামান।

তিনি বলেন, “আমিও তদন্ত কমিটির কাছে ঘটনার বিবরণ দিয়েছি। তদন্তকালে ঘটনাস্থল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলার সময় বেশ কয়েকজনের কাছে নিহত মন্টু চাকমার বিষয়টি জানতে চেয়েছে কমিটি। কিন্তু তার পরিচয় সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি।”

তিনটি গাড়ির একটিতে থাকা বাঘাইহাট কেন্দ্রের পোলিং কর্মকর্তা ইয়াসমিন আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গাড়িতে তো নির্বাচনের কাজে জড়িতরা ছাড়া অন্য কেউই থাকার কথা না। আমি শুনেছি মন্টু চাকমা গাড়ির হেল্পার ছিলেন।”

চালক কিংবা হেলপারও ‘নয়’

মন্টু চাকমা গাড়িচালকের সহকারী বা হেলপার ছিলেন বলে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর এসেছিল। তবে তা নাকচ করে দিয়েছেন গাড়ি ভাড়া দেওয়া ব্যক্তিরা।

বাঘাইহাট জিপচালক সমিতির সভাপতি মো. রহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আক্রান্ত বহরের তিনটি জিপই আমাদের সমিতির। নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের জন্য দেওয়া হয়েছিল। গাড়ি তিনটির তিন চালক ও তিন হেল্পারের মধ্যে মন্টু নামে কেউ নেই।”

তিনি জানান, চালকদের মধ্যে ইসমাইল গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একজন হেল্পার সাদ্দাম গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন।

অন্য দুই চালক এবং দুই হেল্পার অক্ষত আছেন। তারা হলেন চালক আল আমিন ও রুবেল এবং হেলপার ডিপজল চাকমা ও পূর্ণজীবন চাকমা।

বহরের বাকি যে গাড়িটি বিজিবির ছিল, তাতে শুধু বিজিবির সদস্যরাই ছিলেন।

চালক আল আমিন ও রুবেল বলেন, বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছনোর পর তাড়াহুড়োর মধ্যে কোন গাড়ি থেকে মন্টুর লাশ নামানো হয়েছিল, তা তাদের এখন মনে নেই। তারা জানতেন যে গাড়ির সবাই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট লোক।

নির্বাচনী দায়িত্বেও ‘ছিলেন না’

মন্টু চাকমা নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারীদের কেউ নন বলে নিশ্চিত করেছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (কর্মকর্তা) নাদিম সারোয়ার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “নিহত মন্টু যে নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারীদের কেউ না, তা নিশ্চিত। তার ব্যাপারে আমার বেশি কিছু জানা নেই।”

সেদিন আক্রান্ত গাড়ির একটিতে থাকা পোলিং কর্মকর্তা ইয়াসমিন আক্তারও বলছেন, মন্টু চাকমা নির্বাচনী কাজে ছিলেন বলে তাদের জানা নেই।

এলাকায়ও খোঁজ নেই

বাঘাইছড়ি থানার ওসি এমএ মন্জুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্টুর পরিচয় পাওয়া গেছে। তার স্বজনরা লাশ নিয়ে দাহ করেছে।”

এ বিষয়ে আরও জানতে হলে এই হত্যামামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাঘাইছড়ি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

জাহাঙ্গীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মন্টু চাকমা দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের তিনকিলো এলাকার তপতি চাকমার ছেলে। তার বাবা তপতি চাকমাকে সঙ্গে এনে রূপকারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শ্যামল চাকমা লাশ নিয়ে গেছেন।

কিন্তু ওই ঠিকানা ধরে খুঁজে মন্টু নামে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

রূপকারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শ্যামল চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছু লোকজন আত্মীয়স্বজন দাবি করে লাশ নিতে এসেছিল। পুলিশ আমার কাছে সই চেয়েছে, আমি সই দিয়েছি। কিন্তু আমি তাকে চিনি না।”

মেরুং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রহমান কবির রতন বলে, “মন্টু নামে আমার ইউনিয়নে কেউ সম্প্রতি নিহত হয়নি।”

কালের কণ্ঠের দীঘিনালা প্রতিনিধি জাকির হোসেনের বাড়ি মেরুং ইউনিয়নের মধ্যবেতছড়ি গ্রামে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুরো ইউনিয়নে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মন্টু নামে কেউ নিহত হয়েছেন বলে খবর মেলেনি।”

দীঘিনালা থানার পুলিশও মন্টু নামে কেউ নিহত হয়েছে বলে খবর পায়নি।

দীঘিনালা থানার ওসি উত্তম চন্দ্র দেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্টু চাকমা নামে কারও বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কোনো তথ্য চায়নি। আমরা জানিও না। সুতরাং এই নামের এই উপজেলার কেউ মারা যায়নি বলেই আমরা ধরে নিচ্ছি।”

পাহাড়ি সংগঠনও ‘চেনে না’

মন্টু চাকমা নিজেদের দলেরও কেউ নন বা এই নামের কাউকে চেনেন না জানিয়েছেন বাঘাইছড়ির নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমার দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত চাকমা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা গণমাধ্যমেই মন্টু চাকমার নামটি জেনেছি। সে কে সেটা আমরা জানি না। আমাদের দলের আর সংশ্লিষ্ট কেউ হলে আমরা নিশ্চিত জানতাম।”

মন্টু অন্য কোনো সংগঠনের বলেও তথ্য পাওয়া যায়নি।

ফলে মন্টু চাকমা আসলে কে, তিনি নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারীদের গাড়িতেই বা কীভাবে উঠলেন, তার কোনো দিশা দিতে পারছে না কেউই।