শেলাবুনিয়ায় শায়িত হলেন ফাদার রিগন

বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিক মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগনের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর এক বছর পর তার মরদেহ এদেশে এনে বাগেরহাটে দাফন করা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও বাগেরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2018, 12:37 PM
Updated : 21 Oct 2018, 12:41 PM

রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে মোংলা উপজেলায় তার প্রতিষ্ঠিত শেলাবুনিয়া চার্চের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

গতবছর ২০ অক্টোবর ইতালির ভিচেঞ্চায় মারা যান ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ পাওয়া ফাদার মারিনো।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে তার মরদেহবাহী টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়।

ইতালির মিলানে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ইকবাল আহমেদ এবং ফাদার মারিনোর ভ্রাতষ্পুত্র মারিনো কাভেস্ট্রো মরদেহের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছেন। ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ হেলিকপ্টার মরদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যায় বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।  

বীর প্রতীক সাজ্জাদ আলী জহিরের তত্ত্বাবধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।

এর আগে সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে তাকে বহনকারী বিশেষ হেলিকপ্টার মোংলা উপজেলা পরিষদ চত্বরে পৌঁছায়। সেখানে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বিউগল বাজিয়ে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

এ সময় অন্যান্যের মধ্যে পরে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায়, মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম, খুলনা ধর্ম প্রদেশের বিশপ রমেন বিশ্বাস, ফ্রান্সিস সুদান হালদার, শেলাবুনিয়া ধর্মপল্লির পালক পুরোহিত শেরাফিন সরকার উপস্থিত ছিলেন।

খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক সাংবাদিকদের বলেন, ফাদার মারিনো রিগন ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি এদেশে ধর্ম প্রচারে এসেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে দাঁড়ান। তিনি ধর্ম, শিক্ষা, নারী অধিকার, স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা কল্যাণমুখী কাজে নিজেকে সমর্পণ করেন।

“তার প্রতি মোংলাসহ দেশের মানুষ কৃতজ্ঞ। প্রতি বছর তার জন্মদিনে মোংলায় রিগন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর রিগন মেলা করে তাকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখা হবে।”

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ফাদার মরিনো রিগানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার তাকে সম্মান জানিয়েছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেন।”

বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন, “আমরা একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে হারালাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভিনদেশি একজন মানুষ মৃত্যুর কথা চিন্তা না করে ক্যাম্প খুলে যুদ্ধাহত মানুষের সেবা করে গেছেন। তার ঝণ শোধ হবার হয়।”

সরকার তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করে এদেশের শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করেছে, বলেন টুকু।

নতুন প্রজন্মের কাছে ফাদার রিগনের এদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা তুলে ধরার আহ্বান জানান জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক ফররুখ হাসান জুয়েল।

মারিনো রিগন ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের কাছে ভিল্লভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। দেশের নানা জায়গা ঘুরে মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে থিতু হন এবং সেখানে চার্চ ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

তবে তার কাজ ধর্ম প্রচারের গণ্ডির মধ্যে থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা সেবা ও দুঃস্থ নারীদের উন্নয়নে তিনি সব সময় উদ্যোগী ছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে নিজের চার্চে তিনি গোপনে একটি চিকিৎসা ক্যাম্প খোলেন।

সেই ক্যাম্পে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ফিরে গেছেন রণাঙ্গনে। মুক্তিযুদ্ধের হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমও তাদের একজন।

মুক্তিযুদ্ধে ফাদার মারিনো রিগনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়। ২০১২ সালে তাকে দেওয়া হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।