১৩ কোটি টাকার দরপত্রে পে-অর্ডার জালিয়াতির অভিযোগ বরগুনায়

বরগুনা সদর উপজেলায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের ১৩ কোটি টাকার দরপত্রে পে-অর্ডার জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে।

মনির হোসেন কামাল বরগুনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Feb 2017, 03:21 PM
Updated : 14 Feb 2017, 05:50 PM

কাজ না পাওয়া ঠিকাদারদের অভিযোগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. ইসরাফিল সঙ্গে যোগসাজশে স্থানীয় কিছু ঠিকাদার জালিয়াতির মাধ্যমে কাজ পাওয়া নিশ্চিত করেছেন।

পূবালী ব্যাংক বরগুনা শাখার ব্যবস্থাপক বলেছেন, অল্প টাকার পে-অর্ডার কেটে তাতে বেশি টাকার অংক বসিয়ে সরকারি দপ্তরে ব্যবহার করার তথ্য তিনিও পেয়েছেন।

পিআইও ইসরাফিল দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করলেও নিয়ম অনুযায়ী পে-অর্ডারের তথ্য্ লিপিবদ্ধ না রাখায় তাকে কারণ দর্শাতে বলেছেন সদর উপজেলার ইউএনও আজহারুল ইসলাম।

পাশাপাশি, জালিয়াতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। 

উপজেলা পিআইও কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বরগুনা সদর উপজেলার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২২টি গ্রুপে গ্রামীণ সড়কে ছোট ছোট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য দরপত্র ডাকা হয়। দরপত্র জমার শেষ দিন ছিল ২৯ ডিসেম্বর।

সরকারি ক্রয় নীতিমালা ও দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, কাজের মোট মূল্যের তিন শতাংশের পরিমাণ অর্থের ফেরতযোগ্য পে-অর্ডার যুক্ত করে এসব দরপত্র জমা দেওয়ার কথা।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২২টি কাজের জন্য  মোট দুই হাজার ৪৩৮টি দরপত্র জমা পড়ে। সেসব দরপ্রস্তাবের ভিত্তিতে গত সোমবার সদর উপজেলার ইউএনও আজহারুল ইসলামের উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে কাজ বণ্টন করা হয়।

কাজ না পাওয়া ঠিকাদারদের অভিযোগ, কিছু ঠিকাদার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে দরপ্রস্তাবের সঙ্গে জাল পে-অর্ডার জমা দিয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা পে-অর্ডার যাচাই না করেই কাজ বণ্টন চূড়ান্ত করেছেন। এ নিয়ে ইউএনওর কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদনও করেছেন একাধিক ঠিকাদার।

নাসরিন সুলতানা পলি নামের একজন ঠিকাদার বলেন, একজন ঠিকাদার যদি সব কটি গ্রুপের দরপত্রে অংশ নেন, তাকে মোট ৬৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার কাটতে হবে।

“অথচ একটি চক্র তা না করে জাল পে-অর্ডার যুক্ত করে জেলার সব কটি গ্রুপের দরপত্রে অংশ নিয়ে লটারির মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। এতে সরকার ও সাধারণ ঠিকাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।”

মিজানুর রহমান রিয়াজ নামের আরেক ঠিকাদার বলেন, সদর উপজেলার ১, ২, ১২ ও ১৯ নম্বর কাজের (গ্রুপ) এক কোটি ১৩ লাখ টাকার চারটি কাজ পেয়েছেন ঠিকাদার মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

“তিনি দরপত্রের সঙ্গে যে পে-অর্ডার যুক্ত করেছেন, তার সবই জাল। তার ব্যাংক স্টেটমেন্টও বানোয়াট। নিয়ম অনুযায়ী এসব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা থাকলেও পিআইও ইসরাফিল মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে তা করেননি।”

এভাবে ‘ঠিকাদারদের একটি সিন্ডিকেট’ জাল পেঅর্ডার ব্যবহার করে সদর, আমতলী ও তালতলী উপজেলার অনেক কাজ হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন রিয়াজ।   

এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চারটি কাজ পাওয়া ঠিকাদার মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তার দাবি, নিয়ম মাফিক ঠিকঠাক কাগজই তিনি জমা দিয়েছেন।

বরগুনা জেলা ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, প্রতিটি দরপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত পে-অর্ডারের ব্যাংক ও সিরিয়াল নম্বর লিখে রাখার নিয়ম। কিন্তু পিআইও ইসরাফিল তা করেননি।

“জাল পে-অর্ডারের তথ্য গোপন করার অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে এ কাজ করেছেন তিনি। এটি সরকারি ক্রয় নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।” 

পে-অর্ডার নিয়ে বরগুনায় যে জালিয়াতি হয়েছে, তা পূবালী ব্যাংক বরগুনা শাখার ব্যবস্থাপক মো. রুহুল আমিনের কথায় স্পষ্ট।

এ নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটে ব্যাংকের অবস্থান স্পষ্ট করতে গত মঙ্গলবার বিকেলে বরগুনা প্রেসক্লাবে একটি বিবৃতি পাঠান তিনি।

সেখানে বলা হয়, “কতিপয় প্রতারকচক্র অল্প টাকার পে-অর্ডার কেটে তা স্ক্যান করে কালার প্রিন্টের মাধ্যমে বেশি টাকার অংক বসিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ব্যবহার করে আসছে। এটি ব্যাংকের সুনাম নষ্ট করতে পারে।”

পূবালী ব্যাংক বরগুনা শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দরপত্র জমা পড়ার আগে গত ২৭ নভেম্বর ওই ব্যাংক থেকে ২০টির বেশি ১০ টাকার পে-অর্ডার করেন এক ব্যক্তি। এরকম আরও বেশ কিছু পে-অর্ডার নেওয়া হয়েছে, যেগুলো জালিয়াতিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।

তবে কে বা কারা সেদিন ওই পে-অর্ডারগুলো তুলেছিল, তা প্রকাশ করতে চাননি ব্যবস্থাপক রুহুল আমিন।

পিআইও মো. ইসরাফিল ঘুষ নেওয়া বা অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করলেও দরপত্রের সঙ্গে দেওয়া পে-অর্ডারের তথ্য লিপিবদ্ধ না রাখার কথা স্বীকার করেছেন। তার ভাষ্যই, ‘সময়ের অভাবে’ তা করা হয়নি।

সদর উপজেলার ইউএনও আজহারুল ইসলাম বলেন, কেন সব দরপত্রের তুলনামূলক স্টেটমেন্টে পে-অর্ডারের তথ্য লিখে রাখা হয়নি, তা তিনি পিআইও ইসরাফিলকে জিজ্ঞেস করেছেন।

“ইসরাফিল এর সদুত্তর দিতে পারেননি। আমি তাকে চিঠি দিয়ে কারণ দর্শাতে বলেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।”

ঠিকাদারদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, “জাল পে-অর্ডারের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। যেসব ঠিকাদার কাজ পেয়েছেন, তাদের জমা দেওয়া পে-অর্ডার সঠিক ছিল কি না যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।”

বরগুনা সদর উপজেলায় এর আগে পিআইও ছিলেন রণজিৎ কুমার সরকার। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে গেলে আমতলী ও তালতলী উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পিআইও মো. ইসরাফিলকে সদর উপজেলারও দায়িত্ব দেওয়া হয়।