সাঁওতালপল্লীতে বিচারিক হাকিম ও পিবিআইয়ের তদন্ত শুরু

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের ইক্ষু খামারের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে সাঁওতাল বসতি উচ্ছেদ, অগ্নিসংযোগ, হামলা, লুটপাট ও হত্যা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে বিচার বিভাগ ও পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)

গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2016, 09:19 AM
Updated : 27 Dec 2016, 03:52 PM

উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. শহিদুল্লাহ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন গাইবান্ধার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম ময়নুল হাসান ইউসুফ।

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বগুড়া জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল মাদারপুর সাঁওতাল পল্লীতে পৌঁছায়।

তদন্তকারীদের দল দুটি আলাদাভাবে মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া ঘুরে দেখেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল ও বাঙালি পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন। আগুনে পোড়া ঘরের কিছু আলামতও তারা সংগ্রহ করেন।

গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদ অভিযানের সময় ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের অভিজ্ঞতা ও অভিযোগ মুখ্য বিচারিক হাকিম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে জানান।

আকতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ওই ঘটনায় স্বপন মুরমু ও টমাস হেমব্রমের করা মামলার তদন্ত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে তারা এসেছেন।

“ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।”

মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. শহিদুল্লাহ জানান, সেদিনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল ও বাঙালিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করেছেন তিনি। তদন্ত শেষে তিনি উচ্চ আদালতে প্রতিবেদন পাঠাবেন।

এদিকে তদন্ত দল আসার খবরে অধিগ্রহণ করা জমি ফেরত ও দোষীদের বিচারের দাবিতে তীর ধনুক, লাঠিসোঁটা নিয়ে মাদারপুর গ্রামে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ক্ষতিগ্রস্তরা।

১৯৬২ সালে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। ওই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।

পরে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে বসবাস শুরু করে তারা। ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে।

সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে।

সংর্ঘষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই কল্যাণ চক্রবর্তী ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে সাড়ে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় চার সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।

অন্যদিকে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট ও উচ্ছেদের ঘটনায় মুয়ালীপাড়া গ্রামের সমেস মরমুর ছেলে স্বপন মুরমু গত ১৬ নভেম্বর অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন; তার মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

দশদিন পর গত ২৬ নভেম্বর সাঁওতালদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত টমাস হেমব্রম বাদী হয়ে ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে ৫০০-৬০০ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ দাখিল করেন। এছাড়া হাই কোর্টে দুটি রিট আবেদন হয়।

ঘটনার প্রায় এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা একটি ভিডিওর ভিত্তিতে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।

 

ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সাঁওতাল পল্লীর ভেতরে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়ছেন। কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটি ঘরে লাথি মারছেন এবং পরে এক পুলিশ সদস্য ওই ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেন। পুলিশের সঙ্গে সাধারণ পোশাকে থাকা আরেকজন আগুন অন্য ঘরে ছড়িয়ে দিতেও সহায়তা করেন।

ভিডিওর একটি অংশে আরও কয়েকটি ঘরে আগুন দিতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। তাদের মাথায় ছিল হেলমেট, একজনের পোশাকের পিঠে ডিবি, আরেকজনের পুলিশ লেখা ছিল। 

এই প্রেক্ষাপটে এক রিট আবেদনকারীর সম্পূরক আবেদনে হাই কোর্ট গত ১৪ ডিসেম্বর আদেশ দেয়, উচ্ছেদ অভিযানে ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় কারা জড়িত এবং এতে পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত কি না- তা তদন্ত করতে হবে।

গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে সেই দায়িত্ব দেয় হাই কোর্ট। ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয় তাকে।

এছাড়া স্বপন মুর্মু ও টমাস হেমব্রমের অভিযোগ এজাহার হিসেবে নিয়ে পিবিআইয়ের মাধ্যধমে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।

গত ১২ ডিসেম্বর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সাঁওতালদের যেভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে তা আইনি প্রক্রিয়ায় হয়নি।