তুলশীমালা ধানের চাল সুগন্ধী, ছোট ও অত্যন্ত সুস্বাদু। পোলাও, ফ্রাইড রাইস, বিরিয়ানির জন্য বিশেষ উপযোগী এ চাল অতিথি আপ্যায়নে বেশি ব্যবহৃত হয়।
Published : 16 Jun 2023, 11:48 AM
শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধী ‘তুলশীমালা ধান’ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে।
‘পর্যটনের আনন্দে, তুলশীমালার সুগন্ধে’ এ স্লোগানে শেরপুর জেলার ব্র্যান্ডিং বাস্তবায়নে ২০১৮ সালের প্রথম থেকে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। তার ধারাবাহিকতায় এল এমন সাফল্য।
বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, “আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তুলশীমালা চাল শেরপুর জেলার জিআই পণ্য হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে আমাদের একটি উদ্যোগের সফল পরিসমাপ্তি ঘটল।”
বৃহস্পতিবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ‘ডিসি শেরপুর’ পেইজে বিষয়টি নিশ্চিত করে পোস্টও দিয়েছেন জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার।
তাতে জানা যায়, গত ১২ জুন শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্টস, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের রেজিস্টার খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান এনডিসির স্বাক্ষরিত ভৌগলিক নির্দেশক নিবন্ধন সনদ পেয়েছে তুলশীমালা চাল। সনদে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল থেকে পণ্যটি নিবন্ধিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
সাধারণত একটি নির্দিষ্ট উৎপত্তিস্থলের কারণে কোনো পণ্যের গুণগত মান নিয়ে খ্যাতি তৈরি হলে তাকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার।
শেরপুরের তুলশীমালা চালের এই স্বীকৃতির ফলে এখন রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হবে। জেলার অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি ভৌগোলিকভাবে পরিচিতি বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এবার জেলার পাঁচ উপজেলার সাত হাজার হেক্টর জমিতে তুলশীমালা ধানের আবাদ করা হয়েছিল। এতে প্রায় ১০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে।
প্রচারের স্বার্থে এবার কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ১ কেজি করে চাল প্যাকেট করে মোট ১১ হাজার প্যাকেট তুলশীমালা চাল বাজারজাত করা হয়েছে।
সেই প্যাকেটের গায়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তুলশীমালা চালের গুণাগুণ উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে এই চাল সম্পর্কে সবাই ধারণা অর্জন করতে পারে।
দেশের বিভিন্ন কৃষি মেলায়ও এই চাল সুনাম কুড়িয়েছে। ভোক্তারা জানান, ফিন্নি-পায়েসসহ বিভিন্ন মজাদার খাবার তৈরিতে তুলশীমালার বিকল্প নেই।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, এ ধানের চাল সুগন্ধী, ছোট ও অত্যন্ত সুস্বাদু। পোলাও, ফ্রাইড রাইস, বিরিয়ানির জন্য বিশেষ উপযোগী। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব,পার্বণ ও অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে বেশি ব্যবহৃত হয়।
শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর বলেন, “সারাদেশে সুগন্ধি আতপ যত চাল আছে তার মধ্যে তুলশীমালা চাল স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। বাঙালি কৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তুলশীমালা চাল। বিয়ে-শাদীসহ যে কোনো উৎসব পার্বণে এ চাল না হলে চলেই না।”
তিনি আরও জানান, তুলশীমালাকে আঞ্চলিকভাবে ‘জামাই আদুর’ চালও ডাকা হয়। শত বছরের অধিক সময় ধরে শেরপুর অঞ্চলের মানুষ এ চাল ব্যবহার করছেন। বাড়িতে মেহমান আসলে তুলশীমালা চাল দিয়ে তৈরি করা হয় বাহারি খাবার।
এ চালের কদর দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রয়েছে জানিয়ে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এই চালে তৈরি খাবার খেতে সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর এবং খাবার পর আরাম লাগে শরীরে। প্রবাসীরা এ চাল খুবই পছন্দ করেন। সুযোগ পেলেই নানা মাধ্যমে তারা এ চাল নিয়ে যান।
এ ছাড়া সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা শেরপুরে এলে এ চাল উপহার প্রদান করা রেওয়াজ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে দেশের অন্য প্রান্তের কোনো মেহমান শেরপুর এলেও এ চাল উপহার দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর আরও জানান, আমন মৌসুমে তুলশীমালা ধান আবাদ করা হয়। এ জাতের ধানটি আলোক সংবেদনশীল। বীজ বপনের সময় জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ (শ্রাবণ মাসের প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহ)। ফুল আসে অক্টোবর মাসের শেষ থেকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি।
ধানের রং কালচে ধূসর। এ ধানের জীবনকাল জীবনকাল ১২৫-১৪০ দিন। ধান কাটার সময় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ (অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি থেকে পৌষ মাসের শুরু)।
বলান পদ্ধতির মাধ্যমে এ ধান আবাদ করলে ফলন প্রতি হেক্টরে ধান উৎপাদন হয় তিন থেকে সোয়া তিন টন। বলান ছাড়া ফলন হয় প্রতি হেক্টরে ২.৫০-২.৭৫ টন ধান।
মোটা ধানের চেয়ে এই ধানের উৎপাদন কম হলেও বাজারে দাম অনেক বেশি। তাই চাষিরাও দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
শেরপুর খামার বাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সুকল্প দাস বলেন, জেলা প্রশাসকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষি বিভাগের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তুলশীমালা চাল জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলো। তুলশীমালা ধান চাষীদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে।
“ক্রেতারা যাতে প্রতারিত না হন সেজন্য জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে তৈরি একটি আকর্ষণীয় মোড়কে তুলশীমালা চাল বাজারজাত করা হচ্ছে। সুগন্ধি ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় এ চালের কদর ও চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। ”
এই চাল কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, “ভৌগলিক নির্দেশক নিবন্ধন সনদ হাতে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে যারা অবদান রেখেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। এ অর্জন শেরপুরের সব মানুষের।”
২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পায় জামদানি। এরপর ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, ঢাকাই মসলিন, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, নেত্রকোণার বিজয়পুরের সাদামাটি, বাংলাদেশের কালিজিরা চাল, বাগদা চিংড়ি এবং রাজশাহী-চাপাইনবাগঞ্জের সুস্বাদু ফজলি আম এ স্বীকৃতি পায়।
ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্টস, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) জিআই সনদ দেয়।
আরও পড়ুন