ঢাকার কাছে মৃতপ্রায় এক ‘আন্তর্জাতিক’ ক্রিকেট স্টেডিয়াম

গত সাত বছরে স্টেডিয়ামে কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ গড়ায়নি; জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ খেলাও সেখানে হয় না।

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2023, 07:55 PM
Updated : 17 March 2023, 07:55 PM

মূল মাঠের ডিজিটাল স্কোরবোর্ড অকেজো, ফ্ল্যাডলাইট সব চুরি হয়ে গেছে, দর্শক ছাউনি ও আসন ভাঙা, প্রেস বক্সে বসার মত অবস্থা নেই, ভিআইপি গ্যালারি আর খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুমও ব্যবহারের অনুপযোগী।

ওদিকে আউটার স্টেডিয়াম কচুরিপানায় ভরপুর, একপাশে হচ্ছে সবজির চাষ। বর্ষা মৌসুমে থৈ-থৈ পানি গড়িয়ে আসে মূল মাঠের মধ্যে।

নামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের ভেন্যু হলেও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত ‘খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম’টির অবস্থা বাস্তবে এমনই। এমনকি স্টেডিয়ামের নামফলকের লেখাটিও উঠে গেছে।

জেলা ক্রীড়া সংস্থা, ক্রিকেট স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আন্তর্জাতিক এই স্টেডিয়ামটির এমন দশার পেছনে রয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ-বাংলাদেশ (এনএসসিবি) এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ‘দ্বৈরথ’। অবহেলা আর উদাসীনতা তো রয়েছেই।

বছর দুয়েক আগে মাঠটি সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। গত সাত বছরে স্টেডিয়ামে কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ গড়ায়নি; জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ খেলাও সেখানে হয় না। তবে মাঠটি এখনও পরিত্যক্ত হয়নি; কোনো মতে ক্রিকেটের ঘরোয়া লীগ চালিয়ে নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এনএসসিবির টাকা নেই। অন্যদিকে এই মাঠ সংস্কারের জন্য ইনভেস্ট করতে চায় বিসিবি। কিন্তু তারা এই মাঠের পুরো কর্তৃত্ব চায়। সরকারি এই দুই সংস্থার মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং না হওয়ায় এখন পর্যন্ত মাঠটি এইভাবে পড়ে আছে।

“এই মাঠটি নারায়ণগঞ্জে হলেও পুরো মাঠটির দেখভালের দায়িত্বে এনএসসিবি। তারা চাইলে সংস্কার হবে। আর না চাইলে এইটাও আরেকটা শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম (বগুড়া) হবে। আমাদের আসলে কিছু করার নেই। আমরা কেবল আক্ষেপই করতে পারি।“

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি ও ক্রিকেট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ফারুক বিন ইউসুফ পাপ্পু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিসিবি ও এনএসসিবির মধ্যে এক ধরনের ইস্যু আছে। তবে মাঠটি সংস্কারের ব্যাপারে কথাবার্তা এগোচ্ছে। আমরা আশা করি, মাঠটির গুরুত্ব বিবেচনা করে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।”

২০০০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের পাশে নির্মিত স্টেডিয়ামটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৬ সালের ২৩ মার্চ প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ হয় এ স্টেডিয়ামে। ওই ম্যাচে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় কেনিয়ার।

একই বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়ার প্রথম টেস্ট ম্যাচ হয় ফতুল্লায়। এই মাঠে দুটি টেস্ট, ১০টি ওয়ানডে ও চারটি টি-টোয়েন্টিসহ মোট ১৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়েছে।

সবশেষ ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের কয়েকটি ম্যাচ গড়ায় ২৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার এই স্টেডিয়ামে।

বুধবার বিকালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বাইরে কুতুবপুর ইউনিয়নের রামারবাগ এলাকায় স্টেডিয়ামটির অবস্থান। মূল সড়ক লাগোয়া আউটার স্টেডিয়ামে জন্ম নিয়েছে কচুরিপানা।

সেগুলো গরুকে খাওয়ানোর জন্য কেটে নিচ্ছেন এক ব্যক্তি। আউটারের আরেকপাশে চাষ করা হয়েছে সবজি। অথচ এক সময় এইখানে প্রিমিয়ার লীগ, ফার্স্ট ডিভিশনের খেলাগুলো হত।

তারপর দেয়ালের ভেতরে মূল স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটি মূল সড়ক থেকে কিছুটা নিচে। এলাকাটি শিল্প-কারখানা অধ্যুষিত। সেখানকার অবর্জনাও নর্দমা বেয়ে আউটার স্টেডিয়াসে এসে পড়ছে। 

স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছর ধরেই স্টেডিয়ামটির এমন হাল। তারা মনে করতে পারেন, সাত বছর আগে এখানে ভালো খেলা দেখেছিলেন। এখন আর এই মাঠের খেলার প্রতি কারও কোনো আগ্রহ নেই।  

তারা জানান, একসময় এ এলাকাটি জলাভূমি ছিল। পরে ভরাট করে মাঠ তৈরি করা হয়। এটি মানুষের কাছে নারায়ণগঞ্জ ওসমানী নামে পরিচিত ছিল।

২০০০ সালে নারায়ণগঞ্জের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ ওসমান আলীর নামানুসারে এই স্টেডিয়ামটির নামকরণ করা হয়। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান ও শামীম ওসমানের দাদা। 

‘ফতুল্লা স্টেডিয়াম’ বলেও পরিচিত এই ভেন্যুতে এখন প্রিমিয়ার লীগের খেলা চলছে। গত ১৫ মার্চ থেকে খেলা শুরু হয়েছে।

মাঠটির ভেন্যু ম্যানেজার বাবুল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাইরের আউটার স্টেডিয়ামে তো সারাবছরই পানি। বর্ষা মৌসুমে বেশি সমস্যা হয়। তখন ভেতরের মাঠেও পানি জমে থাকে। এ ছাড়া শুকনা মৌসুমে কিছু ঘরোয়া ম্যাচ চালানো যায়। যেমন এখন প্রিমিয়ার লীগ চলছে।”

এক সময়ে এই স্টেডিয়ামে খেলা ক্রিকেটার এবং বর্তমানে প্রশিক্ষক মনিরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, “আউটার স্টেডিয়ামটিতে অনেক প্র্যাকটিস করেছি। ফার্স্ট ডিভিশন ও প্রিমিয়ার লীগের খেলাও হত এইখানে। অথচ কয়েক বছর যাবৎ তা পানির নিচে।

“বড় দুঃখ লাগে মাঠটির এমন চিত্র দেখলে। আমরা চাই, আন্তর্জাতিকমানের এই মাঠটিকে দ্রুতই সংস্কার করে পুরনো রূপে ফিরিয়ে আনা হোক।”

এদিকে মাঠটি নির্মাণের সময়তেই পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল বলে মন্তব্য জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক খোরশেদ আলম নাসিরের।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই মাঠ নির্মাণই হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। শিল্প-কারখানা বেষ্টিত এই অঞ্চলে ড্রেনেজ ব্যবস্থার দিকে নজর রাখা হয়নি তখন। পাশের সড়কের চেয়ে কয়েক ফুট নিচে স্টেডিয়ামটি। আশেপাশের ডাইং কারখানাগুলোর বর্জ্য এসে সহজেই জমা হয় স্টেডিয়ামে। আউটার তো ৫-৭ বছর যাবৎ পানির নিচে। ওইখানে কচুরিপানা জমে। ভেতরে মূল স্টেডিয়ামের অবস্থাও বেহাল।”

“এই কারণে ২০১৬ সালের পর থেকে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচের আয়োজন করা যায়নি। অথচ ঢাকার থেকে সবচেয়ে কাছের এই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামটি দেশের অন্য অনেক স্টেডিয়ামের তুলনায় অনেক বেশি মানসম্মত। যা হেলায় নষ্ট হচ্ছে। এই মাঠকে সম্পূর্ণ ভেঙে পুনরায় নির্মাণ করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।”

জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, এই স্টেডিয়ামটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার জমিতে নির্মিত হলেও এটির মূল তত্ত্বাবধানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বাংলাদেশ (এনএসসিবি)। সংস্কারের প্রয়োজন হলেও ক্রীড়া পরিষদ এই বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি।

তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মাঠটি সংস্কার করে পুরনো রূপ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেও তা আর এগোয়নি। মাঠটি সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দুই বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি দল ফিজিবিলিটি স্টাডি করে প্রতিবেদনও মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। এরপর আর বিষয়টি এগোয়নি।

স্থানীয় যুবক তারেক মাহমুদ বলেন, “এই মাঠে খেলা দেখছি, খেলছিও৷ এশিয়া কাপের টিকেট কিনতে গিয়ে পুলিশের মাইরও খাইছি৷ সেই মাঠে এখন ভূতুড়ে পরিবেশ৷ এমন সুন্দর আন্তর্জাতিক একটা স্টেডিয়াম নষ্ট হইয়া গেল কারও কোনো চিন্তা নাই৷

“এইটা নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য হতাশার৷ আমরা চাই, স্টেডিয়ামটিকে পুনরায় সংস্কার করে আবারও এর জৌলুশ ফিরিয়ে আনা হোক৷”

বিসিবির গণমাধ্যম ও যোগাযোগ কমিটির প্রধান তানভীর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফতুল্লার স্টেডিয়াম নিয়ে তাদের করার কিছু নেই। মাঠ বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে।

“সবগুলো মাঠের মালিকই আসলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এখানে বিসিবির তরফ থেকে আমাদের কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। ক্রীড়া পরিষদ থেকেই সব কিছু করা হয়। মাঝে মধ্যে ক্রীড়া পরিষদের কাজের ধীরগতির কারণে আমরা নিজ উদ্যোগে অনেক কিছু করে নিই। যেহেতু আমাদের জাতীয় পর্যায়ে অনেক সময় প্রয়োজন পড়ে, তাই আমরা করে নিই।

“ফতুল্লা মাঠে এখন হল সব কিছু নতুন করে তৈরি করার ব্যাপার। বুয়েট থেকে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী এই মাঠ ৬ ফুট উঁচু করতে হবে। কারণ আশপাশের সবকিছুই উঁচু। রাস্তা, আশপাশের নানান কল-কারখানা, অনেক নতুন ভবনও হয়েছে। সবগুলোই মাঠ থেকে উঁচু। এখন ৬ ফুট মাটি ফেললে গ্যালারির একটা অংশ আবার নিচে চলে যাবে। এটাকে আবার ওপর দিকে ওঠাতে হবে। অর্থাৎ সব কিছু নতুনভাবে পরিকল্পনা করে করতে হবে।”

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এরই মধ্যে এটা নিয়ে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি যতটুকু জানি, এই ব্যাপারে একনেকে এই পরিকল্পনা উত্থাপন করার পর সেটি পাসও হয়ে গেছে। শুধু ফতুল্লা নয়, খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের ব্যাপারেও পাস হয়ে গেছে। এখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ডিপিপি তৈরির কাজ করছে। এটি তৈরি হয়ে গেলে আগামী অর্থ বছরের মধ্যে ওরা টেন্ডারে যাবে।

“ক্রীড়া পরিষদ টেন্ডার করলে ঠিকাদার যারা কাজটি পাবে, তারা কাজ শেষ করবে। এরপর মাঠটি যখন আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে, আমরা তখন আন্তর্জাতিক ভেন্যুর জন্য যেসব সুবিধাদি প্রয়োজন ও করণীয়, তা নিয়ে কাজ করব।”

বিসিবি ও এনএসসির দ্বন্দ্বের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তানভীর আহমেদ বলেন, “ব্যাপারটা আসলে অমন কিছু নয়। ক্রীড়া পরিষদের সাথে বিসিবির সংঘাতের কিছু নেই। স্টেডিয়ামটা যেহেতু ডিএনডির ভেতরে এবং এলাকাটা নিচু। তাই এখানে পানি জমে। শুধু স্টেডিয়াম না, আশপাশের এলাকায়ও পানি জমে থাকে। আশপাশে অনেক উঁচু স্থাপনা হয়ে যাওয়াও পানি সরার কোনো উপায় নেই।

“এখন সেনাবাহিনীকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। ডিএনডির সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে খুব সম্ভবত দেড় হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলছে। যা আগামী বছর শেষ হতে পারে। এটা হয়ে গেলে আর ডিএনডির ভেতরে পানি জমার বিষয়টি থাকবে না।”

তিনি বলেন, "ক্রীড়া পরিষদ যদি মনেও করে যে, ঠিক আছে আমরা মাঠটা ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ করে রাখলাম। কিন্তু তখন পানিটা সরবে কোথায়? এজন্য ডিএনডির কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি চারপাশ উঁচু হয়ে যাওয়ায় মাঠের পুরো প্রাঙ্গণটাই উঁচু করে ফেলতে হবে। সেক্ষেত্রে এটি তো সরকারি কাজ। সরকার এটার জন্য ফান্ড দেবে। বেশ কিছু ধাপ পার হয়ে তারপর এটার টেন্ডার হবে।

"এখন যেহেতু বিশ্ব মন্দার একটা বিষয় চলছে। এটি মাথায় রেখে সরকার বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আমাদেরকে এটা করে দেবে, আমরা তত তাড়াতাড়ি খেলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারব।"