“শীতের কালে এক দিকে আয় কম, অন্যদিকে বাজারের সব জিনিসের দাম বেশি।”
Published : 26 Jan 2025, 08:37 PM
“এই ঠান্ডায় বের হতে পারি না। গাড়ি নিয়ে বের হলেও হলেও যাত্রী নেই। ফলে ইনকামও নেই।”
কথাগুলো বলছিলেন, রংপুরের কানউনিয়া উপজেলার রিবকশরা চালক ৩৫ বছর বয়সী আমিনুর ইসলাম।
তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রংপুরের জনপদ। এ অঞ্চলে মাঘ মাসের শরুর দিকে শীতের দাপট কম থাকলেও গত তিন-চার দিন ধরে তা বাড়তে শুরু করেছে।
ঘন কুয়াশার সঙ্গে বইছে হিমেল বাতাস; দেখা মিলছে না সূর্যের। এতে ভোগান্তি আর দুর্ভোগে পড়ছে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। পাশাপাশি এ অবহাওয়ার কারণে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, “ঘন কুয়াশা ও বাতাসের আর্দ্রতা বৃদ্ধির কারণে উত্তরের জেলাগুলোতে ঠাণ্ডা আর মধ্যরাত থেকে ঘন কুয়াশা বেড়েছে। এছাড়া দিনের বেশির ভাগ সময় সূর্যের দেখা মিলছে না।”
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের মৃদু শৈত্য প্রবাহ বইয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে সকাল ৬টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় ৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১১ দশমিক ০ ডিগ্রি, রংপুরে ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি, নীলফামারীর ডিমলায় ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এছাড়া দিনাজপুরের তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১০ দশমিক ১ ডিগ্রি, লালমনিরহাটে ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি ও গাইবান্ধায় ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
রংপুরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, হালকা কুয়াশার সঙ্গে তীব্র হিম বাতাস বইছে। আগুন জ্বালিয়ে শীত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। কাজ ছাড়া মানুষ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। অনেকটাই জনশূন্য হয়ে পড়েছে ব্যস্ততম সড়ক ও হাটবাজারগুলো।
তবে সংসার খরচ মেটাতে দরিদ্র আয়ের মানুষরা শীত উপেক্ষা করেই কাজের সন্ধানে ছুটছেন। ভোরে কুয়াশা থাকার কারণে বিভিন্ন সড়কগুলোতে যানবাহনগুলোকে চলাচল করতে দেখা গেছে হেডলাইট জ্বালিয়ে।
রংপুর মহানগরীতে আসা অটোরিকশা দুলাল মিয়া ও শ্রমজীবী রমিজ উদ্দিন বলছিলেন, গত তিন-চারদিন ধরে রংপুরে তীব্র শীত। যাত্রী ও কাজ নেই বললেই চলে।
রংপুর পঞ্চগর রোডের ট্রাক চালক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “রাত থেকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে সবকিছু। বিশ ফুট দূরত্বের মধ্যে বোঝা যায় না, সামনে থেকে গাড়ি আসছে কি-না। ফগলাইট (কুয়াশার জন্য বিশেষ লাইট) জ্বালিয়েও লাভ হচ্ছে না। দুর্ঘটনা এড়াতে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। না হলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
ওই রোডের ইজিবাইক চালক সাজেদুর রহমান বলেন, “ঘন কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাসে মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হচ্ছে না। বেলা দেড়টা বাজে অথচ দুইশ টাকাও ভাড়া পাইনি। আগে দিনে সাত থেকে আটশ টাকা আয় হতো অটো চালিয়ে। এখন অর্ধেক টাকাও হয় না।
“খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। শীতের কালে এক দিকে আয় কম, অন্যদিকে বাজারের সব জিনিসের দাম বেশি।”
গংগচড়া উপজেলার মহিপুর এলাকায় দিনমজুর রিপন বলেন, “রাতে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ে, সকাল থেকে মেলে না সূর্যের দেখা। এর ফলে ঘর থেকে মানুষ কম বের হচ্ছে। এ কারণে আয় রোজগার কম, পরিবারের নিয়ে অনেক কষ্টে দিন যাপন করতে হচ্ছে। রাস্তায় মানুষ কম থাকায় আয় তেমন হচ্ছে না।”
এদিকে ঠান্ডায় সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। এছাড়া গত এক সপ্তাহে ১ হাজার শিশু ও বয়স্ক রোগী ঠান্ডাজনিত রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন বলে হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে।
এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার আশিকুর রহমান বলেন, “আমার নয় বছরের ছেলে রোহানকে হাসপাতার ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছি। শিশু ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা বেশি। এর ফলে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম পেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। আবার রোগীরর চাপ বেশি থাকার কারণে অনেকে বারান্দায় বা করিডোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন।”
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট এস এম নুরুন্নবী বলেন, “শীতের প্রকোপ বেশি থাকায় ঠান্ডাজনিত রোগ নিয়ে শিশু ও বয়স্করা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গত সপ্তাহ থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
এদিকে শীত নিবারণে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে একই হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। বর্তমানে ৪৬ জন দগ্ধ রোগী এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগ আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, “খরকুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে অনেকেই দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া শীতের সময়টাতে রোগব্যাধি বাড়ছে।”
এ অবস্থায় আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার ও শীতের সময় গরম কাপড় ব্যবহার করার পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে রংপুরের ৮ উপজেলায় ৫ হাজারের বেশি শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে বলে রংপুর জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শীতের প্রকোপ বাড়ায় এ কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।”
নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দিনমজুর গফ্ফার মিয়ার বলছিলেন, “শীতকালে আসলেই অনেক কষ্ট। জমিতে কাজ করতে পারতাছি না। পানি ধরলে হাতে লেগে আসে। আমাদের খুব কষ্ট।”