শত বছরের প্রাচীন বগুড়ার শিবগঞ্জের উথলী মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের ২২ গ্রামে স্বজনদের মিলনমেলা হয়।
Published : 17 Nov 2024, 07:43 PM
নবান্ন উৎসব উপলক্ষে বগুড়ার শিবগঞ্জের উথলীতে বসেছে হরেক রকম মাছের মেলা। রোববার ভোর থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত চলে মেলাটি।
দূর-দূরান্তের মানুষ এখানে আসেন ছোট-বড় মাছ কিনতে। ঘরে ঘরে বড় মাছ ও নতুন সবজি কিনে মেয়েজামাইসহ স্বজনদের আপ্যায়নের রেওয়াজ এই এলাকার দীর্ঘদিনের।
মেলায় এক হাজার মণের বেশি মাছ কেনাবেচা হয়েছে। ১৭ কেজি ওজনের ব্লাককার্প, ১১ কেজি ওজনের কাতল, সাত কেজির রুই, চার-পাঁচ কেজির কাঁকলে, বিগহেড, বাগার, সিলভার কার্প, চিতল, বোয়ালসহ হরেক রকমের মাছ বিক্রি হয়েছে এই মেলায়।
বিশালাকৃতির রুই-কাতলা ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা, চিতল ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ২৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা দরে ব্ল্যাককার্প, বিগহেড ও সিলভার কার্প মাছ বেচাকেনা হয়।
শত বছরের প্রাচীন উথলী মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের ২২ গ্রামে স্বজনদের মিলনমেলা হয়।
পঞ্জিকা অনুসারে, অগ্রহায়নের প্রথম সপ্তাহে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন নবান্ন উৎসব পালন করা হলেও এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর মাছের মেলা বসে উথলীতে।
উথলী, রথবাড়ি, ছোট নারায়ণপুর, বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবিপুর, গুজিয়া, মেদনীপাড়া, বাকশন, রহবল, মোকামতলাসহ ২২ গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে উৎসবের আয়োজন করা হয়। প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা নতুন ধানের চালে নবান্ন করেন।
নবান্ন উপলক্ষে সেখানে মাছের মেলা বসলেও নুতন ধানের আতপসহ অন্য চাল, জমি থেকে নতুন তোলা শাক-সবজির পসরাও সাজানো হয় মেলা চত্বরে। এই মেলায় নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া মিষ্টি আলু প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
শিবগঞ্জের মোকামতলা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মানিক মিয়া বলেন, তিনি এবার মেলায় ১৭ কেজি ওজনের ব্লাককার্প ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন।
মাছ বিক্রেতা শিবগঞ্জ উপজেলার শরিফুল ইসলাম জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্তত পাঁচ থেকে ১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে রাত থেকে ২০টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।
মোকামতলা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী স্বপন ইসলাম বলেন, তিনি প্রতি বছর এ মেলায় মাছের দোকান দেন। এবার আমদানি কম হওয়ায় মাছের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য বেশি দামে মাছ কিনতে হয়েছে। এ কারণে ক্রেতারা মাছ কিনতে হিমসিম খাচ্ছেন।
উথলীর নবান্ন মেলায় বিক্রির জন্য আশপাশের এলাকার পুকুরগুলোতে সৌখিন চাষিরা মাছ মজুদ করে রাখেন। এলাকার কে কত বড় মাছ মেলায় তুলতে পারেন যেন তারই প্রতিযোগিতা চলে চাষিদের মধ্যে।
এ ছাড়া আড়ৎদাররা তো আছেনই। এলাকার লোকজনও প্রায় প্রতিযোগিতা করে তুলনামূলক বড় মাছ কিনে বাড়িতে নিয়ে যায়। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসব করলেও আশপাশের গ্রামের সব সম্প্রদায়ের মানুষই কেনাকাটা করে।
শিবগঞ্জের ধোন্দাকোলা গ্রামের নিশিকান্ত সরকার জানান, কেউ বলে ৪০০ বছর, কেউ বলে ২০০ বছরের এই ঐতিহ্যবাহী মেলাটি যেমন মাছের জন্য বিখ্যাত, তেমনি মেলার দিন নতুন শাক-সবজিতেও ভরপুর থাকে। এ কারণে আশপাশের লোকজন মেলায় ছুটে আসে।
তিনি বলেন, শুধু মাছ আর সবজিই নয়, মেলার আবহের জন্য সেখানে শিশু-কিশোরদের খেলনার দোকান বসেছে। সেই সঙ্গে মিষ্টান্ন ও দইয়ের একটি বড় বাজারও বসেছে মেলা চত্বরে।
উথলী বাজারের ইজারাদার পিয়াস জানান, আগে মেলাটি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা ব্যাপকতা লাভ করেছে। শুধু আশপাশেরই নয়; পুরো শিবগঞ্জ উপজেলার মানুষ এখানে নবান্নের বাজার করতে আসেন। মাছের মেলার খবর পেয়ে শহর থেকেও অনেকে সেখানে ছুটে যান মাছ কিনতে।