২০০০ সালে জেলায় বনভূমির পরিমান ছিল ৩৯ হাজার ৯৪৩ হেক্টর; যা কমে ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ১৭৪ হেক্টরে।
Published : 22 Oct 2024, 10:59 PM
গাজীপুরে দুই যুগে বনভূমি ও জলাশয় কমেছে দুই তৃতীয়াংশ; সেইসঙ্গে বেড়েছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ।
মঙ্গলবার শহরের পিটিআই অডিটোরিয়ামে ‘পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে গবেষণা জরিপের ফলাফলে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) এ গবেষণা জরিপ পরিচালনা করেছে। এতে সহায়তা করেছে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন (বিআরএফ), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।
২০২৩ সালে গবেষণা জরিপ চালানো হয়। এই গবেষণার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু নদী হলেও সঙ্গত কারণেই এতে পরিবেশের অন্যান্য উপাদানগুলোর বর্তমান অবস্থা, বিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানে বেলার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলামের সভাপতিত্বে ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেনের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন।
জরিপ তথ্য উপস্থাপন করেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। এতে প্যানেল আলোচক হিসেবে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের অধ্যাপক অসীম বিভাকর, গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম এবং গাজীপুর পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বক্তব্য দেন।
গবেষণা বলছে, ২০০০ সাল থেকে গত ২৩ বছরে এক সময়কার সবুজ শ্যমল গাজীপুরের পরিবেশের বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বনাঞ্চল, জলাশয়, উন্মুক্ত জায়গা। তবে বেড়েছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও শহরায়ন। ঘটেছে, বন দখল, জলাশয় ভরাট ও গাছ কাটা।
২০১১ সালে জেলায় মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৩০ লাখের কাছাকাছি। ২০২২ সালে তা এসে ঠেকেছে ৫০ লাখের বেশি। দেশের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে আট হাজার ১২৬ জন বসবাস করছে।
পরিবেশগত সমীক্ষা বলছে, ২০০০ সালে জেলায় মোট জলাভূমির পরিমান ছিল ১১ হাজার ৪৬২ হেক্টর বা মোট আয়তনের ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৫৬৮ হেক্টর বা মোট আয়তনের ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ।
একটি জেলার মোট আয়তন অনুযায়ী অন্তত ৭ থেকে ১৪ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। অথচ গাজীপুর আদর্শ মান থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তার ওপর তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, চিলাইসহ নদ-নদীগুলো শিল্পবর্জ্য ও নানামুখী মারাত্মক দূষণের শিকার। যার প্রভাব পড়ছে জেলার সার্বিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে।
একটি জেলার মোট আয়তন অনুযায়ী ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হয়। ২০০০ সালে গাজীপুরে বনভূমির পরিমান ছিল ৩৯ হাজার ৯৪৩ হেক্টর বা ২৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে জেলায় বনভূমির পরিমান এসে ঠেকেছে ১৬ হাজার ১৭৪ হেক্টর বা ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে। অথচ এই জেলায় রয়েছে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের মত গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি।
গাজীপুরে ২০০০ সালে চাষ করা মোট কৃষি জমির পরিমান ছিল ১৮ হাজার ২৭০ হেক্টর। ২০২৩ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩০৭ হেক্টরে। জেলায় ২০০০ সালে মানববসতি ছিল ৮৫ হাজার ৫৭৩ হেক্টর এলাকায়; যা মোট আয়তনের ৫০ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০২৩ সালে এসে বসতি এলাকা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ১৭৯ হেক্টর; যা মোট আয়তনের ৬৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
২০০০ সালে শিল্প এলাকা বিস্তৃত ছিল ৯ হাজার ৭৩৬ হেক্টর জমিতে। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৮৭৭ হেক্টরে। ২০০০ সালে জেলায় খোলা জায়গার পরিমান ছিল পাঁচ হাজার ৪৩৬ হেক্টর; যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র এক হাজার ৩১৬ হেক্টরে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন এবং নগরায়ণ ধ্বংসের প্রভাবের কারণে গাজীপুর এখন দেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই জেলার পরিবেশগত অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। এখানে উল্লেখযোগ্য হারে বনভূমি ও জলাভূমি দখল করা হচ্ছে। বায়ু ও পানি দূষণের মাত্রা অতি উচ্চ; যা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে জনস্বাস্থ্যে।
এমন পরিস্থিতিতে বেলা, বিআরএফ, আরডিআরসি এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এরপর আগত বিভিন্ন দপ্তরের ও পেশার মানুষ তাদের মতামত দেন। ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন বলেন, “প্রতিদিনই বন দখলের অভিযোগ পাচ্ছি। আলোচনা ও সালিশ করতে হচ্ছে। তবে এসব দখলের বিরুদ্ধে আমাদের প্রত্যেকের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারি দায়িত্বের সর্বোচ্চ ব্যবহার করব।”
সমস্যা দেখে আশাহত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বেলার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, “আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। দখল-দূষণ চাইলেও সরকার বা বেলা একা সমাধান করতে পারবে না। আমরা নগরায়ণ চাই, উন্নয়নও চাই কিন্তু সেই উন্নয়ন চাই না, যে উন্নয়ন আমাদের পরিবেশকে দেখে না।”
আলোচনা সভায় বাপার গাজীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক হাসান খান, ভাষা শহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক, গাজীপুর বি এম কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবির, গাজীপুর নদী পরিব্রাজক দলের সাধারণ সম্পাদক এম আসাদুজ্জামান সাদ, আবু সাঈদ চৌধুরী এবং অধ্যাপক আসাদুজ্জামান আকাশ বক্তব্য দেন।