“গ্রামবাসীর সম্মিলিত আয়োজনে এ শিরনি বিতরণ করা হয়। এ ভাতের মেলার জন্য ভাত নিয়ে আসতে কাউকে বলতে হয় না।”
Published : 17 Jan 2025, 06:19 PM
বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত নানা সংস্কৃতি। এই ধারায় মৌলভীবাজারে প্রায় ৭০০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ‘সাদা ভাতের মেলা’।
প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম বুধবার জেলার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের বাজরাকোনায় হযরত শাহ মঈন উদ্দিন (রহ.) মাজার ঘিরে জমে ওঠে এ মেলা।
এদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ছোট-বড় হাঁড়ি-পাতিল ভর্তি সাদাভাত আর ক্ষীর নিয়ে হযরত শাহ মঈন উদ্দিন (রহ.) মাজারে আসেন এবং মাজারের পাশে রাখা বড় দুটি পাত্রে তা সংগ্রহ করা হয়। পরে সুশৃঙ্খলভাবে সেসব খাবার ‘শিরনি’ হিসেবে হাজার হাজার নারী-পুরুষের মাঝে বিতরণ করা হয়।
আর এই আয়োজনকে মাজার সংলগ্ন বিশাল খোলা মাঠে বসে মেলা। যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি খেলনা, ইমিটেশনের গহনাসহ নানা বাহারী পণ্যের পসরা সাজান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া মজাদার বিভিন্ন খাবারসহ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সবজিও বিক্রি হয় মেলায়।
তবে অন্য মেলার মতো এখানে কাউকে টোল বা চাদা দিতে হয় না। তাই বেচাবিক্রি যেমন ভালো, তেমনি আয়-রোজগারও ভালো হয় ব্যবসায়ীদের।
হযরত শাহ মঈন উদ্দিন (রহ.) মাজারের মোতাওয়াল্লী মো. আজাদ মিয়া বলেন, প্রায় ৭০০ বছর আগে মনুমুখ ইউনিয়নের বাজরাকোনায় আগমণ ঘটে ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফরসঙ্গী হযরত শাহ্ মইন উদ্দিনের (রহ.)।
তিনি ছিলেন অলৌকিক গুণের অধিকারী, তাই মানুষ আপদে-বিপদে ছুটে যেতেন তার কাছে। ফলে সেখানে হযরত শাহ্ মইন উদ্দিনের (রহ.) একটি আস্তানা গড়ে ওঠে।
সাদা ভাতের মেলার সূচনা নিয়ে তিনি বলেন, “সেসময় হযরত শাহ্ মইন উদ্দিনের (রহ.) আস্তানা ঘিরে একটি গরু জবাই করে শিরনির আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু শিরনি চলাকালে একটি ব্যক্তি গরুটির মালিকানা দাবি করে সেটি চুরি করে আনা হয়েছিল বলে জানান।
“তখন পীর সাহেব আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে গরুটির দেহের অবশিষ্টাংশ একত্র করে জীবিত করে মালিককে ফিরিয়ে দেন এবং গ্রামবাসীকে বলেন, এখন থেকে তাদের সব শিরনি হবে কোনো পশু জবাই না করেই।”
এর পর থেকে এখানে শুধু সাদাভাত দিয়ে তার সঙ্গে ক্ষীর মিশ্রণ করে শিরণি হয়ে আসছে।
তবে এই ভাতের আয়োজন মাজার থেকে করা হয় না, বরং মানুষ তাদের নানান মানত করে নিজের বাড়ি থেকে সাদাভাত ও ক্ষীর রান্না করে মাজারে নিয়ে আসেন এবং ক্ষীর মিশিয়ে দিনভর এই ভাতের শিরনি আবার মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয় বলে জানান তিনি।
বিভিন্নজনের বিভিন্নপ্রকার চালের রান্নাকৃত ভাতের সংমিশ্রণ হলেও তা খুবই সুঘ্রাণযুক্ত ও সুস্বাদু হয়। তবে এ শিরনি বিতরণ বুধবারে শেষ হয়ে গেলেও তারপরদিন বৃহস্পতিবারও মেলা চলতে থাকে।
মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান বলেন, “হযরত শাহ্ মইন উদ্দিন (রহ.) মাজারকে ঘিরে প্রতি বছর ওরস মোবারক ও ভাতের মেলার আয়োজন করা হয়। এখানে দুরদুরান্ত থেকে এবং পাশ্ববর্তী ইউনিয়নগুলো থেকে মানুষ শিরনি নিয়ে আসে।
“একটা নির্ধারিত স্থানে শিরনি রাখা হয় এবং হাজার হাজার মানুষের মাঝে সুন্দর-সুশৃঙ্খলভাবে শিরনি বিতরণ করা হয়। শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক এই শিরনি বিতরণে নিয়োজিত থাকেন।”
শিরনি বিতরণের আগে মিলাদ এবং দেশ-বিদেশে বসবাসকারী সবার জন্য দোয়া করা হয় বলে জানান তিনি।
গ্রামবাসী রহিম মিয়া ও কামাল উদ্দিন জানান, তারা বিশ্বাস করেন এই শিরনি খেলে রোগ-বালাই দূর হয়। তাই তারা এই শিরনি খান এবং অনেকে বাড়িতেও নিয়ে যান।
বাজরাকোণা জামে মসজিদের সহ-সভাপতি সুমন বক্স আনসারী বলেন, “এখানে যে কোনো নেক নিয়ত করলে কবুল হয় বলে মানুষের মাঝে ধারণা আছে। এরই ধারাবাহিকতায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন।
“গ্রামবাসীর সম্মিলিত আয়োজনে এ শিরনি বিতরণ করা হয়। এ ভাতের মেলার জন্য ভাত নিয়ে আসতে কাউকে বলতে হয় না। মানুষ এমনিতেই নিয়ে আসেন। ”
তিনি আরও বলেন, “প্রতিবছরই এখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের খাবার জমে যায়। সেগুলো আবার হাজার হাজার মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয় তবে আমি কখনো শুনিনি এখানে শিরনি শর্ট হয়েছে বা কেউ পায়নি।”