“চিকিৎসা নিয়ে এলাকায় ফিরে আবেদন করলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করে সরকারি সহায়তার জন্য আহত মৌয়ালের নাম প্রস্তাব করা হবে।”
Published : 15 May 2024, 07:33 PM
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে বাঘের থাবা থেকে বেঁচে ফেরা মৌয়াল আবদুল কুদ্দুস এবার কুমিরের মুখ থেকে ফিরে এসেছেন।
সহযোগী মৌয়ালদের প্রাণান্তর প্রচেষ্টায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন বলে জানালেন সুন্দরবনের মধু সংগ্রহকারী অভিজ্ঞ এ মৌয়াল। ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন কুদ্দুসের সঙ্গে থাকা পাঁচ মৌয়ালও।
তারা জানান, গভীর সুন্দরবনে ঢুকে মধু কাটার পর নদীতে গোসল করতে নামেন ছয়জন। হাঁটু থেকে সামান্য উঁচু পানিতে গোসল করছিলেন। হঠাৎ আবদুল কুদ্দুসকে পানির মধ্যে ঘুরপাক খেতে দেখেন অন্যরা। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতবিহ্বল। আবদুল কুদ্দুস পানিতে ঘুরপাক খাচ্ছেন, আর পানিতে ভেসে উঠছে রক্ত। হঠাৎ পানির ওপরে উঠে এল কুমিরের লেজ।
বাকিদের বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না। আবদুল কুদ্দুসকে কুমিরে ধরেছে। সঙ্গে সঙ্গে হাতে থাকা মগ ও পাতিল নিয়ে সজোরে পানিতে আঘাত করতে লাগলেন বাকি পাঁচজন। তারা আবদুল কুদ্দুসের দুই পা ধরে টানাটানি শুরু করলেন। এভাবে চলতে থাকল তিন থেকে চার মিনিট। হঠাৎ শিকার ছেড়ে নদীর গভীরে চলে যায় কুমিরটি।
ঘটনাটি ঘটে ১১ মে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কলাগাছিয়া নদীতে। ৫৫ বছর বয়সি আবদুল কুদ্দুসকে কুমিরের হাত থেকে বাঁচাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তারই ছোট ভাই আবদুল হালিম।
আবদুল কুদ্দুস জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের মৃত মোকছেদ সানার ছেলে। সোমবার লোকালয়ে ফেরার পর মঙ্গলবার তাকে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাত-আট দিন আগে বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন থেকে মধু সংগ্রহের পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে সুন্দরবনে ঢোকেন ছয় মৌয়াল। তাদের দলে ছিলেন দুই ভাই আবদুল কুদ্দুস ও আবদুল হালিম। ঘটনার দিন অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি চাক পাওয়ায় সবাই খোশমেজাজে ছিলেন।
দুপুর আড়াইটার দিকে কলাগাছিয়া নদীর চরে সবাই একসঙ্গে গোসল করতে নামেন।
ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আবদুল কুদ্দুস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুমির যখন আমার হাত কামড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি। কুমির ঘুরপাক খেতে থাকায় আমিও সমানতালে পানিতে ডুবে গিয়ে আবার ভেসে ওঠি। নিশ্বাস নিতে না পারায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় আর কিছু মনে নেই।”
কুদ্দুসের ভাই আবদুল হালিম বলেন, শুরুতে তারা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। ফলে খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তবে কুমিরের লেজ আছড়ে পড়া দেখে তিনি জীবনের মায়া ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভাইকে বাঁচাতে চিৎকার করে দলের অন্য চার সদস্য বক্স গাজী, শহিদুল, সিরাজুল ও এলাই বক্সের সহযোগিতা চান।
“এক পর্যায়ে সবাই মিলে আবদুল কুদ্দুসের দুই পা ধরে টানাটানি এবং পানিতে প্রচণ্ড শব্দ তৈরি করলে কুমিরটি শিকার ছেড়ে চলে যায়।”
মৌয়াল সিরাজুল ইসলাম জানান, কুমির চলে যাওয়ার পর আবদুল কুদ্দুসকে ডাঙায় নিয়ে সরিষার তেল ও ক্ষতস্থানে আগাছা লাগিয়ে রক্ত বন্ধ করেন। ঝড়ের কারণে দেরিতে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন মৌয়ালরা। তাই সোমবার রাতে তারা লোকালয়ে পৌঁছান।
আবদুল কুদ্দুসের বাঁ হাত গুরুতর জখম হয়েছে জানিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তরিকুল ইসলাম বলেন, “কামড়ের চিহ্ন দেখে শিকারি কুমিরটি তুলনামূলক ছোট মনে হয়েছে।”
আবদুল কুদ্দুস ও আবদুল হালিম ৩৫-৩৬ বছর ধরে মাছ, কাঁকড়া শিকারসহ মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে যাতায়াত করেন। এর আগে ২০১৫ সালে মধু কাটতে গিয়ে সুন্দরবনের তালপট্টি এলাকায় বাঘের কবলে পড়েন তারা। তখন দলে ছিলেন সাতজন।
সেদিন বাঘ ঘিরে ধরেছিল গোটা দলটিকে। লাফ দিয়ে আক্রমণের মুহূর্তে বাঘটি দেখতে পান কুদ্দুসের সহযোগী আবদুল আজিজ। তিনি সরে গিয়ে বেঁচে যান।
পরে সবাই চিৎকার এবং লাঠিসোঁটা দিয়ে গাছে আঘাত করে এলাকা ছেড়ে নিজেদের রক্ষা করেন।
২০০৮ সালে মধু কাটতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হন আবদুল কুদ্দুসের খালু দাতিনাখালী গ্রামের গোলাম মোস্তফা।
সুন্দরবনে গিয়ে বাঘ, কুমিরসহ হিংস্র প্রাণী থেকে নিরাপদে থাকার বিষয়ে যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে মৌয়ালদের সতর্ক করা হয় বলে জানিয়েছেন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ কে এম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “বৈধভাবে এসব ব্যক্তি মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে যান। চিকিৎসা নিয়ে এলাকায় ফিরে আবেদন করলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করে সরকারি সহায়তার জন্য আহত মৌয়ালের নাম প্রস্তাব করা হবে।”
এ কে এম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, গত পাঁচ বছরে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে কুমির ও বাঘের আক্রমণে আহত হন দুজন।