হঠাৎ উজানের ঢলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
Published : 30 May 2024, 04:22 PM
গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটের পাঁচ উপজেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে।
সিলেটে সোমবার থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলা টানা বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে পাঁচ উপজেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল। অনেক সড়ক ডুবে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল।
সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবুল কুদ্দুস বুলবুল জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলায় ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
এর মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলায় ৫৬টি, জৈন্তাপুর উপজেলায় ৪৮টি, কানাইঘাট উপজেলায় ১৮টি, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৩৫টি ও জকিগঞ্জ উপজেলায় ৫৮টি রয়েছে। পাশপাশি মেডিকেল টিম মাঠে রয়েছে।
মানুষজন এরইমধ্যে আয়শ্রকেন্দ্রে উঠতে শুরু করেছেন বলে আবুল কুদ্দুস জানালেও ঠিক কত মানুষ উঠেছে, সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি তিনি।
বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত জেলায় ৩৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজিব হোসেন জানান।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় ‘সারি নদীর’ পানি একদিনে ২০২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
‘সুরমা নদীর’ পানি কানাইঘাট উপজেলা পয়েন্টে ১৯৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৬৬ সেন্টিমিটার ওপরে এবং ‘কুশিয়ারা নদীর’ পানি জকিগঞ্জের অমলসীদ পয়েন্টে ২২০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাঁচ উপজেলার মধ্যে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে ‘খারাপ’ বলে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসাইন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে; প্রয়োজনে তারাও উদ্ধার অভিযানে যোগ দেবেন। জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল-রুম খোলা হয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে।
“বর্তমানে গোয়াইনঘাটে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।”
সিলেট জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে বন্যা কবলিত পাঁচ উপজেলায় ১০০০ বস্তা শুকনো খাবার ও ৭৫ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
এছাড়া ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার ত্রাণসামগ্রী উপজেলাগুলোতে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।
বিকালে গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের বাসিন্দা ও বাজারের ব্যবসায়ী সোহাগ চক্রবর্তী বলেন, “বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসাতে পানি প্রবেশ করেছিল। রাতে বাসার ভেতরে হাঁটু সমান পানি হয়েছিল; খুব কষ্টে রাত কাটিয়েছি। আজ বেলা ৩টার দিকে বাসার পানি কমেছে। তবে বাজারের পানি এখনও পুরো নামেনি; আমার দোকানে পানি ছিল।”
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলছেন, “উপজেলার ৭৫ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জাফলং-বিছনাকান্দিসহ সব পর্যটন এলাকার পর্যটকবাহী নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযান চলছে।”
“এ উপজেলার ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে বুধবার রাতেই ১৬৭টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে থেকে যা ২৫০ এ ছাড়িয়েছে। অনেক মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে পাশের উঁচু বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।” যোগ করেন তিনি।
জৈন্তাপুর নিজপাট এলাকার বাসিন্দা সুভাষ দাশ বাবলু বলেন, “গত রাতে হঠাৎ করে উজানের ঢল নেমে আমাদের নিজপাট ইউনিয়ন প্লাবিত করে দেয়।
“এতে পুরো এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। মানুষজন নৌকার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করতে শুরু করে।”
নিজপাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর এলাহি সম্রাট বলেন, “হিদেরখাল এলাকায় একটি বাঁধের কারণে আমাদের এলাকা প্লাবিত হয়। এই বাঁধ দেওয়ার পর থেকেই আমাদের এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।”
জৈন্তাপুর উপজেলায় বন্যা কবলিতদের মাঝে ইতোমধ্যে ত্রাণ বিরতণ করা হয়েছে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালিক রুমাইয়া জানিয়েছেন।
তিনি বলছিলেন, “পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে বন্যা হয়েছে। তবে সকালের তুলনায় দুপুরে পানি একটু কমেছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং নিম্নাঞ্চলের জনসাধারণ ও গবাদিপশু নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।
“উপজেলায় ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খেলা হয়েছে; এছাড়া উপজেলার সব স্কুল-কলেজও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খোলা রাখা হয়েছে।”
কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা নাসরিন বলেন, “উপজেলা সদর, পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোতে বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ চলছে। প্রশাসন সর্তক অবস্থানে রয়েছে।”
টানা বৃষ্টিতে বেড়েছে সিলেটের নদ-নদীর পানি, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজিব হোসেন জানান, মে মাসের ২৯ দিনে সিলেটে ৭০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মে মাসে সিলেটে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৫৬৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার থেকে ৫৭০ মিলিমিটার।
২০২২ সালে মে মাসে সিলেটে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৮৩৯ মিলিমিটার। ২০২৩ সালে মে মাসে ৩৩০ দশমিক ০ মিলিমিটার এবং চলতি বছরের মে মাসে ৭০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ১৯ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
আগামী কয়েকদিন সিলেটে অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান সজিব।