“গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরসহ আশপাশের অনেকেই ইতালি যায়। তাদের সঙ্গেই ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, ভুল করেছি।”
Published : 21 Feb 2024, 03:51 PM
পক্ষঘাতগ্রস্ত পান্নুর শেখের চোখ ঘরের দুয়ারে; প্রতিক্ষণ কেবলই তার মনে হচ্ছে, এই বুঝি ছেলে এসে দাঁড়াবে। জীবনের শেষ সম্বল দিয়ে যে সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন সুদিন ফিরে পাওয়ার আশায়, তার সলিল সমাধির খবর জানেন না এখনও।
ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে গত সপ্তাহে নৌ দুর্ঘটনায় যে ৯ অভিবাসন প্রত্যাশী নিহত হয়েছেন, তাদেরই একজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গয়লাকান্দি গ্রামের ইমরুল কায়েস আপন। তিনি রাজশাহী এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
মা কেয়া কামরুন নাহার ছেলের মৃত্যুর খবর জানলেও অসুস্থ স্বামী পান্নুর কানে তা তোলার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারেননি। নৌকা ডুবিতে নিহতদের মধ্যে তিজনের বাড়ি গোপালগঞ্জে মুকসুদপুর উপজেলার তিনটি গ্রামে।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, লিবিয়া উপকূল থেকে ৫২ জনের একদল অভিবাসী সাগরপথে ইউরোপ যাচ্ছিলেন। যাত্রার মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়া উপকূলে তাদের বহনকারী নৌকায় অগ্নিকাণ্ড হয়।
নিহত আটজনের মধ্যে পাঁচজনই মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা বলে জানিয়েছে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস। তারা হলেন- খালিয়া এলাকার সজল ও মামুন সেখ, কদমবাড়ি এলাকার নয়ন বিশ্বাস, বাজিতপুর নতুন বাজার এলাকার কাজী সজীব এবং কবিরাজপুর এলাকার কায়সার।
বাকিদের মধ্যে মুকসুদপুরের রাগদী এলাকার রিফাত, দিগনগরের রাসেল এবং ইমরুল কায়েস আপন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলা থেকে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন।
মঙ্গলবার বিকালে গয়লাকান্দি গ্রামে আপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ছেলে আপনের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছে তা এখনও অজানা বাবা পান্নুর, তিনি ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য কেবলই বিলাপ করে চলছেন। অন্যদিকে শোকে বাকরুদ্ধ মা কামরুন নাহার কারও সঙ্গে কথা বলছেন না।
পান্নু বলেন, “গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরসহ আশপাশের অনেকেই ইতালি যায়। তাদের সঙ্গেই ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, ভুল করেছি। গত ৮ জানুয়ারি এক্সিম ব্যাংকের টেকেরহাট শাখার মাধ্যমে দালাল রহিমের কাছে ১১ লাখ টাকা পাঠাই।
“রহিম লিবিয়া থাকে, তার বাড়ি মুকসুদপুর উপজেলার রাগদী ইউনিয়নের গজনা গ্রাম। জীবনের সঞ্চিত সব সম্বল দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন কি করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।”
ছেলের সঙ্গে ১২ ফেব্রুয়ারি শেষবারের মত কথা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “তখন সে বলেছিল ১৪ তারিখে ইটালির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। সেদিন তার সঙ্গে প্রায় ১৫ মিনিট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। এরপর তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
কেউ বলেছে আমার ছেলে হাসপাতালে আছে; কেউ বলেছে জেলে। আমি শুধু আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই। তাকে পেলে আমার কোনো অভিযোগ নেই।”
আপনের স্বজনরা জানান, পান্নু শেখ ২০০৪ সালে সৌদি যান। ১৫ বছর পর ২০১৯ সালে দেশে ফিরে একটি কোম্পানিতে ড্রাইভারের চাকরি নেন। এক বছর আগে তিনি পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে সংসারে আয়ের পথ বন্ধ হয়। তাই হাল ধরতে আপন ইতালি যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
পরে আত্মীয় রহিমের মাধ্যমে ১১ লাখ টাকায় ছেলেকে ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠান। ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে নৌকায় করে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেন আপন। এরই মধ্যে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে তার মৃত্যুর খরর বাড়িতে আসে।
পান্নু সৌদি থাকার সময় ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী কেয়া কামরুন নাহার পাবনায় বাবার বাড়িতে থাকতেন। আপন পাবনাতেই পড়াশোনা করে; সেখান থেকেই সে এসএসসিও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে পাশ করে। পরে মেধাবী এই শিক্ষার্থী ভর্তি হয় রাজশাহী এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আপনের বড় চাচি আনোয়ারা বেগম বলেন, “আপনের ছোট বোন মীমের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। এখন তাদের জীবন কিভাবে কাটবে? আপনের জন্ম, বেড়ে ওঠা আর পড়াশোনা পাবনায় হলেও সে মাঝেমধ্যে গ্রামে বেড়াতে আসত। তাকে হারিয়ে আমরা ভীষণভাবে ব্যথিত।”
শুধু আপন নয় রিফাত ও রাসেলের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতে বাড়িতে ভিড় করছেন গ্রামবাসী। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য দালালদের দৌরাত্ম কমাতে আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।