তনু হত্যা: আট বছরেও অধরা হত্যাকারীরা

“পিবিআইয়ে মামলাটি যাওয়ার পর আশা করেছিলাম ন্যায়বিচার পাব, কিন্তু বারবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কিছু দেখি না।”

আবদুর রহমান, কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2024, 11:20 AM
Updated : 20 March 2024, 11:20 AM

কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের আট বছরেও খুনি শনাক্ত বা তদন্তে এখনও কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। দীর্ঘ সময় ধরে তদন্ত এ অবস্থায় থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তনুর পরিবার ও কলেজের সহপাঠীরা।

তারা বলছেন, আট বছরে তদন্তে অগ্রগতি বলতে শুধুই ‘তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন আর আসামি শনাক্তের চেষ্টা’ ছাড়া কিছুই শুনা যায়নি।

মঙ্গলবার তনুর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কুমিল্লা সেনানিবাসের বাসায় দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি এতিমখানায় দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করেছে তার পরিবার। 

এদিকে, দীর্ঘ সময়েও তনু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তার মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। বলতে গেলে বিচার পাওয়ার আশা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছেন তারা।

তনুর পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, খুনের আট বছরে চারটি তদন্ত সংস্থা আর পাঁচবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন ছাড়া তদন্তে কোনো আশার আলো দেখতে পাননি তারা।

শুরুতে থানা পুলিশ, পরে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দীর্ঘ সময় মামলাটি তদন্ত করেও কোনো কূল-কিনারা পায়নি।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে তনু হত্যা মামলার নথি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকার সদর দপ্তরে হস্তান্তর করে সিআইডি।

বর্তমানে সেখানে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক মো. মজিবুর রহমান মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন।

তবে দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে তনুর পরিবারের সদস্যদের কোনো যোগাযোগ নেই বলে দাবি করেছেন তারা।

মঙ্গলবার তনুর বাড়িতে গিয়ে কথা তার মা আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়েটা খুন হওয়ার পর থেকে শরীরটাও ভালো নেই। বেশির ভাগ সময়ই অসুস্থ থাকি। আমার বয়স হয়েছে, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে মৃত্যুর আগে তনুর খুনিদের বিচারটা দেখে যেতে পারব না। নামাজে প্রতিদিন দোয়া করি- মেয়েকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচার যেন আল্লাহ করেন।”

তিনি বলেন, “গত আট বছরের এমন একটি দিন নেই যে- মেয়েটাকে অনুভব করিনি। বারবার মনে হয়, এই বুঝি কলেজ থেকে এসে মা বলে ডাকছে। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যায়, যখন দেখি, খুনিরা এখনও ধরা পড়েনি।

“খুনিদের ফাঁসি না দেখতে পেলে মরেও শান্তি পাব না। এখন আমাদের সঙ্গে তদন্তকারী সংস্থার কেউ কথা বলে না । পিবিআইয়ে মামলাটি যাওয়ার পর আশা করেছিলাম ন্যায়বিচার পাব, কিন্তু বারবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কিছু দেখি না।”

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তনু হত্যা মামলাটি পিবিআইয়ে হস্তান্তরের পর তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই সদর দপ্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. মজিবুর রহমান ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর তনুর বাবা ইয়ার হোসেনকে নিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার ঘটনাস্থল, তনুদের পুরনো বাসভবন, সার্জেন্ট জাহিদের বাড়ি পরিদর্শন করেন।

এর দুইদিন পর ১৭ ডিসেম্বর তনুর বাবার সঙ্গে আবারও দেখা করেছেন পিবিআই সদস্যরা। ওই দিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করে ঢাকায় ফিরে যান।

এরপর ২০২১ সালের শুরুতে আরেক দফা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আসেন পিবিআই সদস্যরা। গত বছর তনুর এক খালাত বোনের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য তাকে নোটিশ করলেও শেষ পর্যন্ত তার সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেন, “আট বছর হয়ে গেল; কিন্তু খুনিরাই এখনো শনাক্ত হলো না। খুনিদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচার হোক এটাই আমার কথা।

“খুনিদের বিচার না হলে মরেও শান্তি পাবো না। তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন। মামলা কী অবস্থায় আছে সেটাও জানি না আমরা।”

তনুর ভাই আনোয়ার হোসেন রুবেল বলেন, “বোনের খুনিরা শনাক্ত হলেও মনে শান্তি পেতাম। কিন্তু এখনও খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে, এজন্য খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমাদের বাবা-মা অসুস্থ। তারা প্রতিনিয়ত তনুর খুনিদের বিচার দেখার অপেক্ষায় থাকেন।”

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই সদর দপ্তরের পরিদর্শক মো. মজিবুর রহমান বলেন, “মামলাটি অধিক গুরুত্ব দিয়ে আমরা আন্তরিকভাবে তদন্ত করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে বেশ কিছু অগ্রগতি আছে। আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের শনাক্ত করার।

“আমাদের তদন্ত থেমে নেই। আমরা তদন্তে কোনো অবহেলা করছি না। যখন প্রয়োজন তখন তনুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। যোগাযোগ নেই বিষয়টি সঠিক নয়।”

২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে নাট্যকর্মী তনুর মরদেহ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে উদ্ধার করা হয়। সেনানিবাসের ভেতরে স্টাফ কোয়ার্টারে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তনু। হত্যাকাণ্ডের দিন সন্ধ্যায় ৩০০ গজ দূরে আরেকটি স্টাফ কোয়ার্টারে ছাত্র পড়াতে গিয়েছিলেন তিনি।

পরদিন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তনুর লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত হয়। ওই দিনই অজ্ঞাতদের আসামি করে কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন তনুর বাবা।

মামলার তদন্তভার পুলিশ, ডিবি হয়ে সিআইডির হাতে যায়। আলামত সংগ্রহের পর সিআইডি জানায়, হত্যার আগে তনুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল।

আদালতের নির্দেশে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ তনুর লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করা হয়। দুই দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তনুর মৃত্যুর কারণ খুঁজে না পাওয়ার তথ্য জানায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ।

এর পরের বছর ২০১৭ সালের মে মাসে সিআইডি তনুর পোশাক থেকে নেওয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে তিনজন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। এ ছাড়া তনুর মায়ের সন্দেহ করা তিনজনকে ২০১৭ সালের ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত সিআইডির একটি দল ঢাকা সেনানিবাসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তবে ওই সময়ে তাদের নাম গণমাধ্যমকে জানায়নি সিআইডি।

পুরনো খবর:

তনু হত্যা: ডিএনএ প্রতিবেদনে ‘আটকে’ ময়নাতদন্ত

তনু হত্যা: সিআইডির ডিএনএ রিপোর্ট ময়নাতদন্তকারীদের হাতে

Also Read: তনু হত্যার সাত বছর: বিচারের আশা ‘ছেড়েই’ দিয়েছে পরিবার

Also Read: তনু হত্যা: ৬ বছরেও খুনি শনাক্ত না হওয়ায় ক্ষোভ স্বজনদের

Also Read: তনু-মিতুরাও বিচার পাক, দাবি নারী নেত্রীদের