হঠাৎ এসেছে পানির স্রোত, ঘর থেকে মূল্যবান বা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রও বের করতে পারেনি বেশিরভাগ মানুষ।
Published : 26 Aug 2024, 12:44 AM
ট্রাক চালক মো. ইউসুফের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে বন্যায়।
ফেনীর মুহুরি সেতু সংলগ্ন বালুর মহালের কাছে তার বাড়ি। গত মঙ্গলবার পানি আসতে শুরু করে, তার পরদিন সব কিছু রেখে জীবন বাঁচাতে বের হয়ে আসতে হয়েছে এক কাপড়ে।
রেল লাইনের পাশে একটি উঁচু জমিতে তাঁবু টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ইউসুফের পরিবারটি। ত্রাণ সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে ভালোই, খাবারের সংকট আপাতত নেই। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাতর তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এত পানির স্রোত না দেখলে আপনারা কল্পনা করবেন না। পুরা ঘর পানির নিচে। এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হইছি। এ বানের পানি সবাইকে নিঃস্ব করে দিছে।”
পাহাড়ি ঢলে ফেনীর একাংশে আকস্মিক ফল নানা সময় হলেও এমন প্রবল মাত্রার ও বিশাল এলাকা জুড়ে বন্যা বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই, প্রবীণরাও দেখেনি। একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় বের হতে হয়েছে মানুষকে। ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রও ফেলে আসতে হয়েছে। গবাদি পশু, হাঁস মুরগি, পোষা প্রাণীও উদ্ধার করা যায়নি।
জেলা সদর থেকে শুরু করে ছয়টি উপজেলার বেশিরভাগ এলাকাই তলিয়ে গেছে পানিতে। বেশিরভাগ বাড়ির নীচ তলা পর্যন্ত ডুবে আছে চার-পাঁচ দিন ধরে।
ফাজিলপুর স্টেশনের পাশে সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজে আশ্রয় নিয়েছেন কৃষক জামাল উদ্দিন ও তার পরিবার। এখানে ত্রাণ সহায়তা ভালোই আসছে, শুকনো খাবার দিয়ে যাচ্ছে মানুষ। কিন্তু এক কাপড়ে থাকার কষ্টটা পোড়াচ্ছে, পয়ঃনিষ্কাষণের সংকটও আছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব।
জামালের বাড়িতে গোলাভরা ধান ছিল। তিনি বলেন, “গোলায় ধান আছিল, বেগগুন ভাসি গেছেগই, হসল (ফসল) যা চাষ কইচ্চি, বেগগিন নষ্ট অই গেছে।
“লোকজন ম্যালা রিলিফ দের (দিচ্ছে), কিন্তু ঘরবাড়ি যে নষ্ট অই গেছে, আংগো তো সহায় সম্বল সবই শেষ, ইয়ানতুন ঘুরি খারাইতে ম্যালা কষ্ট অইব।”
নিম্ন আয়ের বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর প্রায় সবারই একই চিত্র। যাদের বাড়ি নীচ তলায়, তারা ছাদে বা দোতলা, তৃতীয় তলায় আশ্রয় নিয়েছেন, নিজের এলাকা ছেড়ে আশেপাশের স্কুল কলেজ, প্রতিবেশী, স্বজনদের বাড়ি, ইউনিয়ন পরিষদ বা অন্য কোথায় মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে কাদের।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বন্ধুদেরকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার থেকে এলাকায় ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন। তিনিও দুর্গতদের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই উদ্ধারকর্মী বলেন, “যে ক্ষতিটা ফেনীর হয়ে গেছে, সেটা দেখার জন্য দেশ প্রস্তুত আছে কিনা, সেটা হলো প্রশ্ন।”
ফেনী সদরের ফাজিলপুর বালুর মহাল সংলগ্ন রেল লাইনে স্ত্রী কানু রানী দাশকে নিয়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন লক্ষ্মীন্দর দাশ। সত্তরোর্ধ্ব মানুষটি ধরে জীবিকা চালান। এত পানি জীবনে কখনো দেখেননি- সে কথা বললেন আলাপচারিতায়।
তার বাড়ি ফাজিলপুর ইউনিয়নের শিবপুর জেলে পাড়া। মুহুরী নদীর তীরে অবস্থান এর। ফলে বন্যার ধাক্কাটা লেগেছে শুরুতেই।
লক্ষ্মীন্দর বলেন, বুধবার দুপুরের পর থেকে পানি বাড়ছিল। সন্ধ্যায় ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে পানি এত বেশি বেড়ে যায় যে এক কাপড়েই ঘর থেকে বের হয়ে হয় তাদের। পরিবারের ১০ জন সদস্যের আশ্রয় হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে।
"আংগো হেনীত এত হানি কোনোদিনও অ ন (হয়নি)। অষ্টাশির বন্যায়ও আংগো ঘর ডুবে ন (ডোবেনি), এবার আচুক্কা (হঠাৎ) হানি আয় বেগ্গিন লন্ডভন্ড করি দিছে।”
এই সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার কারণে শনিবার বিকাল থেকে পানি কমতে থাকার পরও মানুষজনের মনে দুঃখবোধের শেষ নেই। পানি নেমে যাওয়ার পর সহায় সম্বলের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি দেখতে হবে তাদের।
স্থানীয়রা জানান, রোববার আগের দিনের চেয়ে অন্তত তিন থেকে চার ফুট পানি কমেছে।
তবে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে আনুমানিক এক কিলোমিটার উত্তরে ফাজিলপুর রেল স্টেশন। সেখানে আশ্রয় নিয়েছে কয়েকশ মানুষ।
মহাসড়ক থেকে স্টেশন সড়ক পাঁচ দিন ধরে কোথাও বুক আবার কোথাও কোমর সমান পানিতে নিমজ্জিত ছিল। সেই পানিতে হেঁটে বা রেল লাইন ধরে মুহুরি ব্রিজের পাশ দিয়ে যাতায়াত করতে হয়েছে লোকজনকে।
ফাজিলপুর স্টেশনের দোকানি শাহ আলম। তার দোকানে বসে গল্প করছিলেন চার-পাঁচ জন যুবক। তাদের পাশে আরও চার/ পাঁচজন, যাদের সবার বয়স পঞ্চাশের বেশি।
শাহ আলম বলেন, “৮৮ সালের বন্যা আমরা দেখেছি। দেশের অনেক জায়গায় ক্ষয়ক্ষতি হলেও ফেনীতে কিছু হয়নি। নীচু জায়গাগুলোর ঘরের উঠান পর্যন্ত পানি হয়েছে। ওই বছর বন্যার পানি দুয়েক দিনের মধ্যে নেমে গিয়েছিল। তবে এ বছর পানিও বেশি, ক্ষতিও বেশি। ফেনীর মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি এত পানি কখনও দেখেনি ফেনীর মানুষ।”