শুধু গল্পেই থাকবে বিশ্বকাপের এই মাঠ

বিশ্বকাপ ইতিহাসে এই স্টেডিয়ামটির শুধু নাম থাকবে, কিন্তু কোনো অস্তিত্ব থাকবে না!

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরদোহা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2022, 06:23 AM
Updated : 6 Dec 2022, 06:23 AM

দূর থেকে ঠিক স্টেডিয়াম মনে হয় না। চারদিকে কন্টেইনারের সারি। একটার পাশে আরেকটা, উপরে আরেকটা, সারি সারি সাজানো। সমুদ্র বন্দর এলাকায় যেমন দেখা যায়। কিন্তু এর ভেতরেই সবুজ আঙিনা। কন্টেইনারগুলো গ্যালারি, সেখানে চেয়ার পাতা, ফুটবলপ্রেমীদের বসার জায়গা। এখানে বসে তারা গলা ফাটান, নিজেদের দলকে অনুপ্রেরণা জোগান। কিন্তু ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’ নামের এই মাঠটি বিশ্বকাপের পর ‘গল্প’ হয়ে যাবে! 

কাতার বিশ্বকাপে সাত ম্যাচের ভেন্যু ছিল এই স্টেডিয়াম। মেক্সিকো-পোল্যান্ড ড্র ম্যাচ দিয়ে শুরু, সোমবার ব্রাজিল-দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচ দিয়ে শেষ। এবারের আসরে এখানে আর কোনো ম্যাচ হবে না। এই স্টেডিয়ামটিও ইতিহাসে থাকবে শুধু অস্তিত্বহীন নাম হয়ে। 

কাতার বিশ্বকাপের আটটি স্টেডিয়ামের মধ্যে এর নামটি বড়ই অদ্ভূত। লু্সাইল, আল জানোব কিংবা খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের মতো নাম নয় এটির। নয়শ ৭৪টি শিপিং কনটেইনার দিয়ে তৈরি বলে এই নাম স্টেডিয়াম ৯৭৪। ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই একমাত্র স্টেডিয়াম, যেটি পুরোপুরি অপসারণযোগ্য। বিশ্বকাপের পর এই কনটেইনারগুলো সরিয়ে ফেলা হবে, পুনরায় ব্যবহার করা হবে আগের কাজে। 

এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, যে দেশগুলি স্টেডিয়াম নির্মাণে অসমর্থ, চাইলে এর অংশগুলো তাদেরকে দিয়ে দেওয়া হবে। সেটা হলে হয়তো এশিয়ার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে এই কনটেইরারের ‍টুকরোগুলো। কিন্তু ইতিহাসে, ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতিতে ঠিকই ৪৪ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই মাঠ রয়ে যাবে গল্প হয়ে। 

কনটেইনারদের দিয়ে বানানো বলে এর গায়ে নান্দনিকতার ছোঁয়া তেমন নেই। আবার একেবারে কাটখোট্টা নয় এটি দেখতে। হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত এই স্টেডিয়ামের কনটেইনারের ভেতর থেকে উঁকি দিলে উপসাগরীয় উপকূল এবং পশ্চিম উপসাগরীয় আকাশচুম্বী ভবনগুলির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়। মাঠের প্রবেশপথেও আছে পানির ফোয়ারা, খা খা মরুভূমিতে যেখানে পানির দেখা মেলাই ভার! 

ব্রাজিল জিতলে তাদের সমর্থকদের স্মৃতিতে থাকবে আরও বেশি করে থাকবে এই স্টেডিয়াম। এর আঙিনাতেই দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠেছে তারা। এই ম্যাচে নেইমার, রিশার্লিসন, ভিনিসিউস জুনিয়র, লুকাস পাকেতাদের পায়ে ফুটেছিল সুন্দর ফুটবলের ফুল। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা ব্রাজিল সমর্থকরা এ ম্যাচেই ফুটবলের ভাষায় আমি থেকে আমরা হয়ে, অচেনা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্বার নৃত্যে হয়েছিল মাতোয়ারা। 

পোল্যান্ডের বিপক্ষে ‘ফাইনালে’ রূপ নেওয়া গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটি জয়ের জন্য আর্জেন্টাইনদের স্মৃতিতেও অমলিন থাকবে এই স্টেডিয়ামটি। দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের আলেক্সিস মাক আলিস্তের, হুলিয়ান আলভারেস, ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপে, পর্তুগিজ তারকা ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর, কিংবা ব্রাজিলের কাসেমিরোর স্মৃতিতে অটুট থাকবে স্টেডিয়াম-৯৭৪। 

দক্ষিণ কোরিয়ানদের কাছে স্বপ্নভাঙার মৃত্যুকূপ হয়ে থাকবে এই স্টেডিয়াম। ব্রাজিলের কাছে এর সবুজেই ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত হয়ে কাতার থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাদের। ঘানা, ডেনমার্ক ও সার্বিয়ার মুখে হাসি ফুটেনি এই স্টেডিয়ামে। সুইজারল্যান্ডকে অবশ্য দিয়েছে জয়-পরাজয়ের ‍মিশ্র অনুভূতি। ব্রাজিলকে দিয়েছে মুঠোভরে, দুই ম্যাচের দুটিতেই জয়। সুইজারল্যান্ডকে হারিয়ে নকআউট পর্ব নিশ্চিত করা ম্যাচে, সবশেষ শেষ ষোলোর মহারণে।   

ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি, জার্মানির অলিম্পিক স্টেডিয়াম, উরুগুয়ের মন্তিভিদিও, মেক্সিকোর আজতেক, ভারতের ইডেন গার্ডেন কিংবা ব্রাজিলের মারাকানার মতো ঐতিহ্যের রঙ এর গায়ে লেগে নেই। কিন্ত সাফল্য-ব্যর্থতার, হাসি-কান্নার স্মৃতি তো জড়িয়ে আছে। বিশ্বকাপ শেষে এটি হারিয়ে যাবে কালের স্রোতে, কিন্তু স্মৃতিটুকু ঠিকই রয়ে যাবে। 

অনাগত দিনে তাই রাস দো আবুদ স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই প্রান্তরে চোখ পড়লে পথিকের মনে নিশ্চিত উঁকি দিবে-এখানেও একদিন মাঠ ছিল, ফুটবল খেলা হতো, আমি থেকে আমরা হয়ে যাওয়ার সুর বেজেছিল। অদ্ভূত এক শূন্যতায় হয়ত ভরে উঠবে পথিকের মন।