ব্রিজবেনে সাকিব-লিটনদের পথের সঙ্গী তিনি

ব্রিজবেনে বাংলাদেশ দলের বাসের চালক ডেবি ড্যানিয়েলস শোনালেন তার গল্প।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2022, 03:00 AM
Updated : 21 Oct 2022, 03:00 AM

“আমি কিন্তু একজন ক্রিকেটারকেও চিনি না…”, সারল্যভরা হাসিতে বললেন ডেবি ড্যানিয়েলস। একটু যেন বিব্রতও হলেন। বাংলাদেশ দলকে খাটো করা হচ্ছে কিনা, এটা ভেবেই হয়তো পরক্ষণে আবার প্রাণোচ্ছল হাসিতে বললেন, “আমি আসলে ক্রিকেট বা খেলাধুলাই তেমন অনুসরণ করি না। কাউকেই খুব একটা চিনি না…।”

সত্যি বলছেন কিনা, নিশ্চিত হওয়ার জন্যই মজা করে জিজ্ঞেস করা হলো, “অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক কে, বলুন তো?” এবার আরও চওড়া হাসিতে তিনি বললেন, “নো আইডিয়া… বিলিভ মি, আমি জানি না। আমার ইন্টারেস্টের জগত আসলে আলাদা। আমি শেন ওয়ার্নের নাম জেনেছি তিনি মারা যাওয়ার পর…।”

এবার বিশ্বাস না করে উপায় নেই। ডেবি আসলেই অন্য জগতের মানুষ!

আপাতত তার জগত ঘিরে কেবল তার বাস। ব্রিজবেনে বাংলাদেশ দলের টিম বাসের স্টিয়ারিং থাকে ডেবির হাতে। হোটেল থেকে মাঠে যাওয়া-আসা কিংবা অন্যান্য জায়গায় নিয়ে যান তিনি।

এই পেশায় আছেন তিনি সাড়ে ৫ বছর ধরে। জীবনে কোনো কাজেই তিনি লম্বা সময় থিতু হননি। যখন যেটা ভালো লেগেছে, সেই পেশাকে আপন করেছেন। যখন বিরক্তি লেগেছে, তাৎক্ষনিক ছেড়ে দিয়েছেন। এভাবেই চলে গেছে জীবনের অনেকটা সময়। বৈচিত্রের খোঁজে আপাতত বেছে নিয়েছেন বাস চালকের কাজ। কাজ করছেন ক্যাঙ্গারু বাস লাইন্সের সঙ্গে। এই পেশা এখন পর্যন্ত দারুণ উপভোগ করছেন তিনি।

একটি আন্তর্জাতিক দলকে বহন করছেন। কিন্তু দলের একজনের নামও তিনি জানেন না, “আমার কাছে ওরা স্রেফ যাত্রী। হ্যাঁ, কাউকে চিনি না যদিও, তবে একটা বিশ্বকাপ দল, একটা জাতীয় দলকে বহন করে নিচ্ছি, এটা আমার জন্য সম্মানের। তবে আমার কাছে সব যাত্রীই সমান। কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার হকি দলও ছিল আমার বাসে অতিথি। কাউকেই চিনি না। আমার কাছে সব যাত্রীই সমান। বাসে যে-ই উঠুক, আমি নিজের দায়িত্ব একইরকম গুরুত্ব দিয়েই পালন করার চেষ্টা করি।”

বিশ্বকাপ দলের সঙ্গী হওয়ার বাড়তি রোমাঞ্চ তাকে স্পর্শ না করলেও তার ঘরেই একজন এটি নিয়ে দারুণ রোমাঞ্চিত। সেই গল্পও শোনালেন ডেবি, “আমার পার্টনার মাইকেল তো বিশ্বাসই করতে চায়নি! সে খুবই খেলাপ্রেমিক, ক্রিকেটের সবকিছু জানে। এই যে বাংলাদেশ দলের বাস আমি চালাচ্ছি, এটা শুনে সে দলের অনেকের কথা জিজ্ঞেস করছে যে এই ছেলেটা কেমন, ওই ছেলেটা কেমন। আমি তো কারও নামও জানি না। কিন্তু (মাইকেল) বাংলাদেশ দলের সবার রেকর্ড, পরিসংখ্যান সব জানে।”

মাইকেলের উত্তেজনা দেখে তাকে দারুণ এক উপহার দিয়ে চমকে দিয়েছেন ডেভি। একটি ব্যাটে বাংলাদেশ দলের সবার অটোগ্রাফ নিয়েছেন তিনি। মাইকেল তা পেয়ে নাকি আনন্দে আত্মহারা, “অটোগ্রাফসহ সেই ব্যাট পেয়ে মাইকেল বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বুঝে উঠতে পারছিল না, সে কী করবে… আমার খুব ভালো লেগেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দীর্ঘদিনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল এটি। মাইকেল খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে এটি।”

বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব পূরণের ফাঁকেই এর মধ্যে একদিন তিনি ভারতীয় দলকে নিয়ে গেছেন গ্যাবায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের প্রস্তুতি ম্যাচ ছিল সেখানে। ক্রিকেট বিশ্বে ভারতীয় দল কত বড় ব্যাপার, সেটির সম্পর্কে ডেভি ধারণা পেয়েছেন তার সঙ্গী মাইকেলের কাছ থেকে।

“আমার পার্টনার তো বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে ভারতীয় দলকে আমি বহন করে নিয়েছি। বিরাট কোহলির নাম আমি তখন প্রথম জেনেছি। কারণ, আমার পার্টনার চোখ বড় বড় করে বলছিল, ‘তুমি বিরাটকে নিয়ে গেছো গ্যাবায়? তুমি জানো সে কত বড় ক্রিকেটার!’ আমার তো কোনো ধারণাই ছিল না। তার কথা শুনে বুঝলাম যে ভারতীয় দল মানে বিশাল কোনো ব্যাপার।”

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সম্পর্কে খুব একটা ধারণা না থাকলেও ক্রিকেট খেলাটা বাংলাদেশে কত বড় ব্যাপার, ক্রিকেটাররা কত বড় তারকা, সেটির একটি ধারণা ডেবি এর মধ্যে পেয়ে গেছেন।

“সেদিন আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে (প্রস্তুতি ম্যাচ) দেখেছি এই দলকে নিয়ে কতটা উন্মাদনা। এখানে অনেক বাংলাদেশি সমর্থক, বাচ্চারা বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের দেখে পাগলের মতো আচরণ করছিল। তখন আমার মনে হলো, ক্রিকেট এই দেশে বড় ব্যাপার, এই ছেলেরা বড় তারকা। এই দূর দেশেও তাদের কত ভক্তরা কতটা আবেগপ্রবণ…।”

ডেবি ক্রিকেট বোঝেন না, কোনো ধরনের খেলা অনুসরণ করেন না। তবে তিনি নিজেও এখন বাংলাদেশ দলের ভক্ত হয়ে গেছেন, “এই ছেলেরা খুবই ভালো আর বিনয়ী। বাসে ওঠার সময় আমাকে ‘হাই’ বলে, নানান সময় নানা কথা বলে। ওদের সঙ্গে এই ডিউটি আমি খুবই উপভোগ করছি।”

বাংলাদেশ দলের এই জনপ্রিয়তা দেখে তার মাথায় ভিন্ন এক চিন্তাও চলে আসে। একটি সাদা ক্যাপ বের করে তিনি দেখালেন, “মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে, এমন একটি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমি। হুট করে ভাবলাম, সংগঠনের তহবিল সংগ্রহের জন্য কোনো কাজ করা উচিত। এজন্যই এই ক্যাপে বাংলাদেশ দলের সবার স্বাক্ষর নিয়ে রাখছি। এটি নিলামে তুলে চেষ্টা করব কিছু তহবিল সংগ্রহ করার।”

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ দলের অনুশীলন শেষে সবাই বাসে ওঠার সময় অটোগ্রাফ নেওয়ার কাজ সেরে ফেলেন তিনি। পরে সেই ক্যাপ দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘কাজ হয়ে গেছে!”

আপাতত আর মাত্র একটি দিন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে ডিউটি আছে ডেবির। শুক্রবার এই শহরে বাংলাদেশ দলের শেষ অনুশীলন। এরপর বাংলাদেশের গন্তব্য হোবার্ট। তবে আরও একবার ব্রিজবেনে আসতে হবে দলকে। ডেবি অপেক্ষায় আছেন সেই সময়ের, “ওদেরকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আশা করি ওরা যখন ফিরবে, তখন আমার ডিউটি থাকবে ওদের সঙ্গে।”