মাহমুদউল্লাহর ভবিষ্যৎ ইয়াসির-হৃদয়দের হাতে

ইয়াসির আলি, তৌহিদ হৃদয়রা পারফর্ম করলে মাহমুদউল্লাহর ‘বিশ্রাম’ রূপ নিতে পারে চূড়ান্তভাবে বাদ পড়ায়।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনি
Published : 13 March 2023, 01:46 PM
Updated : 13 March 2023, 01:46 PM

দল ঘোষণার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ নেই। চোটাঘাতের কোনো ব্যাপার নেই নিশ্চিতভাবেই। স্বাভাবিকভাবে তাই ধরে নেওয়া যায়, ওয়ানডে দল থেকে বাদ মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনের সঙ্গে ফোনালাপে জানা গেল, বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানকে। যদিও তার সেই দাবিতে বিশ্বাস করার লোক চারপাশে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। কেউ বলছেন, ‘সরাসরি বাদ’, কেউ বলছেন ‘বাধ্যতামূলক বিশ্রাম’, কেউ বলছেন বিশ্রামের আবরণে বাদ। আসলে কোনটি সত্যি? 

বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা যাচ্ছে, নির্বাচকদের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যাই আপাতত সত্যি। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচের যে দল ঘোষণা করা হয়েছে রোববার রাতে, সেই দল থেকে আসলেই বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে মাহমুদউল্লাহকে। তবে এই বাস্তবতা বদলে যেতে পারে সামনে। 

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচের আগেই হয়ে যায় আয়ারল্যান্ড সিরিজের দল নির্বাচন। সেই দল নির্বাচনী সভায় নির্বাচকদের পাশাপাশি কোচ, অধিনায়ক ছাড়াও ছিলেন বেশ কয়েকজন বোর্ড পরিচালক। সভায় উপস্থিত এক বোর্ড পরিচালকের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, মাহমুদউল্লাহকে বিশ্রাম দেওয়ার আলোচনাই হয় সেখানে এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। 

বাস্তবতা বলছে, এই বিশ্রামই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের যবনিকা টেনে দিতে পারে, যদি নিজেদের মেলে ধরতে পারেন ইয়াসির আলি চৌধুরি ও তৌহিদ হৃদয়। 

মাহমুদউল্লাহকে বিশ্রাম দেওয়ার পেছনে মূল কারণ এই পজিশনে অন্য দু-একজনকে পরখ করে দেখা। সেই ভাবনায়ই দলে ফেরানো হয়েছে ইয়াসিরকে, রেখে দেওয়া হয়েছে হৃদয়কে। তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হবে বলেও মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে দল। 

ইয়াসির এর মধ্যে তিন সংস্করণেই বাংলাদেশ দলে খেলে ফেলেছেন। জায়গাও হারিয়ে ফেলেছিলেন সব সংস্করণ থেকে। বাদ পড়েছেন কেন্দ্রীয় চুক্তির সব সংস্করণ থেকেও। এবার ফিরতে পারলেন তিনি ওয়ানডে দলে। 

তিন সংস্করণের মধ্যে ওয়ানডেতেই তিনি সবচেয়ে কম ইনিংস খেলেছেন (৫টি)। ফিফটি করছেন একটি, সেই ইনিংসে তার সামর্থ্যের ঝলক তিনি দেখিয়েছেন। গত মার্চে সেঞ্চুরিয়নে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাঁচে নেমে তার ৪৩ বলের ফিফটি ভূমিকা রেখেছিল ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ায়। ছয় নম্বরে যে ধরনের ব্যাটিং দরকার, তার মধ্যে সেই রসদ আছে বলেই মনে করেন নির্বাচকরা। ম্যাচ পরিস্থিতিতে তিনি কতটা নিজেকে মেলে ধরতে পারেন, সেটিই তার দেখানোর ও দেখার সুযোগ এখন। 

হৃদয় এবার বিপিএল দিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন নতুন রূপে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি টি-টোয়েন্টিতেও সেই ধারা তিনি ধরে রেখেছেন। যদিও বড় ইনিংস বা চোখধাঁধানো কোনো কিছু করতে পারেননি। তবে নিজের সামর্থ্য ও মানসিকতার কিছুটা বিজ্ঞাপন তিনি দেখাতে পেরেছেন। 

প্রশ্ন হতে পারে, মাহমুদউল্লাহর জায়গাতেই কেন অন্যদের পরখ করে দেখতে হবে? দল ঘোষণার পরদিন সোমবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে এই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর দিয়েছেন নির্বাচক হাবিবুল বাশার। তিনি বলেছেন, স্রেফ ওই পজিশনের জন্যই ভিন্ন কিছু খুঁজছেন তারা। দেখতে চাইছেন এমন কেউ আছে না কি, যিনি ৬-৭ নম্বর বা এই পজিশনের দাবি আরও ভালোভাবে মেটাতে পারেন। 

যদি রান বা ব্যাটিং গড়ের সাধারণ হিসাব দেখা হয়, তাহলে মাহমুদউল্লাহকে ‘বাদ’ কিংবা ‘বিশ্রামের আড়ালে বাদ’ দেওয়ার কোনো আলোচনাই থাকে না। গত এক বছরে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তার (১৩ ইনিংসে ৪৩৮), তামিম ইকবালের চেয়ে স্রেফ ৮ রান কম। এই সময়ে ব্যাটিং গড়েও মাহমুদউল্লাহর (৪৩.৮০) ওপরে আছেন কেবল তামিম (৪৪.৬০)। 

যদি সীমানা বাড়িয়ে গত ২ বছর ধরা হয়, তাহলে দলের সবচেয়ে বেশি রান মাহমুদউল্লাহরই (৮০৭)। এই সময়ে তার গড় ৪২.৪৭। অন্তত ১০০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ৩৭ গড়ও নেই আর কারও। 

কিন্তু সমস্যা হলো, এই পজিশনে রান ও গড়ের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হলো রান করার ধরন। রানগুলো কীভাবে করা হয়েছে। অনেক সময় বরং এটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে প্রশ্ন কিংবা দল নির্বাচনী সভায় মাহমুদউল্লাহর জায়গায় অন্য কাউকে দেখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনাটা ছিল সেখানেই। 

গত এক বছরে মাহমুদউল্লাহর স্ট্রাইক রেট ৭০.৭৫, গত ২ বছরে স্ট্রাইক রেট ৭১.৫৪। এই সময়ের ক্রিকেটে ৬-৭ নম্বর পজিশনের জন্য যা অনেকটাই বেমানান। 

দল নির্বাচনের সভায় অবশ্য উইকেট, কন্ডিশন ও ম্যাচ পরিস্থিতির বাস্তবতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। অনেক সময়ই মাহমুদউল্লাহকে উইকেটে যেতে হয়েছে দল দ্রুত কিছু উইকেট হারানোর পর। কখনও কখনও হয়তো উইকেটও ছিল না শট খেলার জন্য খুব সহায়ক। কিছু কিছু সময় পরিস্থিতির দাবি ছিল একটু ধরে খেলা। 

তবে এমন অনেক ইনিংসই ছিল, যেখানে তিনি সময়ের ডাক শুনতে পারেননি। কখনও যথেষ্ট দ্রুত রান তুলতে পারেননি, কখনও সেই তাড়না দেখা যায়নি তার ব্যাটিংয়ে, কখনও শুরুতে বিপর্যয় সামাল দিলেও ইনিংসকে ভালো পরিণতি দিতে পারেননি, কখনও আবার সম্ভাবনাময় শুরুকে রূপ দিতে পারেননি কার্যকর ইনিংসে। 

সবশেষ ইংল্যান্ড সিরিজ তার জন্য ছিল বড় সুযোগ। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন কাজে লাগানোর। কিন্তু অপূর্ণই রয়ে গেছে তা। ৩১ ও ৩২ রানের ইনিংস সাময়িকভাবে ইনিংসের ধস থামিয়েছে, কিন্তু রানের সৌধ গড়া হয়নি। সিরিজের শেষ ম্যাচে ক্রিজে যাওয়ার পরপরই একটি ছক্কা মেরেছেন বটে। তবে থমকে গেছেন একটু পরই। প্রথম ম্যাচে তিনি আউট হওয়ার পরও বাকি ছিল ১৩ ওভার, পরের ম্যাচে ১২ ওভার, শেষ ম্যাচে ১৫ ওভারের বেশি। 

তার করার ছিল অনেক কিছুই। কিন্তু ব্যাট হাতে তিনি উত্তর দিতে পারেনি। বরং উচ্চকিত করেছেন প্রশ্নগুলো।

জীবনের পথচলায় ৩৭ বছর পেরিয়ে তার রিফ্লেক্স কমে যাওয়া, ফিল্ডিংয়ের ঘাটতিগুলোও মাঠে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। 

হাবিবুল বাশার সোমবার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, অবসর সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে কোনো আলোচনা তাদের হয়নি। তিনি বারবার জোর দিয়েছেন অন্যদের বাজিয়ে দেখার দিকটাতেই। তবে তাকে যখন সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, বিশ্রাম কাটিয়ে পরের সিরিজে মাহমুদউল্লাহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে দলে আসবেন কি না, তখন তিনি তা এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন, আপাতত শুধু এই সিরিজ নিয়েই তারা ভাবতে চান। 

নির্বাচকের জায়গা থেকে এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া কঠিন বটে। ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ধরনের সোজাসাপ্টা উত্তর আপাতত দেওয়া সম্ভবও নয়। তবে তার এড়িয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বাস্তবতাই প্রকাশ্য হচ্ছে। 

ইয়াসির বা হৃদয় যদি পারফর্ম করেন, তাহলে মাহমুদউল্লাহর জন্য দুয়ার নিশ্চিতভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। যদি তারা সুযোগ কাজে লাগাতে না পারেন, তাহলে হয়তো আবার মাহমুদউল্লাহর আশ্রয়েই ফিরতে হবে দলকে এবং আশা করতে হবে যেন, সেরা সময়ের কিছুটা তিনি ফিরিয়ে আনতে পারেন। যদিও সেই আশার ভিত্তি খুব শক্ত থাকবে না। তবে সেটা হবে বাধ্য হয়েই বা মরিয়া প্রচেষ্টা। 

তার আগে ইয়াসির-হৃদয়দের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়ার ভাবনাই আছে দলের। তাই আয়ার‌ল্যান্ডের বিপক্ষে এই সিরিজেই নয়, সামনে আয়ারল্যান্ড সফরে, এমনকি আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে মাহমুদউল্লাহর বিশ্রাম। 

আইরিশদের বিপক্ষে স্কোয়াডে জাকির হাসানকেও ওয়ানডে দলে নেওয়া হয়েছে প্রথমবার। তবে তাকে মূলত টপ অর্ডারের ভাবনায়ই সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন নির্বাচকরা। বিশ্বকাপের আগে বা সামনের পথচলায় বড় কোনো আসরে তামিম ইকবাল, লিটন কুমার দাস, নাজমুল হোসেন শান্তর কেউ চোটে পড়লে যেন বিকল্প প্রস্তুত থাকে। তবে ছয়-সাত নম্বরের বিবেচনায় ইয়াসির-হৃদয়ের বাইরে সামনে অন্য কেউ বিবেচনায় চলে এলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

আপাতত তাই মাহমুদউল্লাহর ভাগ্য আর তার নিজের হাতে নেই। ফেরার জন্য তাকে কামনা করতে হবে অন্যদের ব্যর্থতা। যদিও ক্রিকেটে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তা আরও বড় সত্যি। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সত্যি, মাহমুদউল্লাহর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এখন শেষের সন্ধিক্ষণে।