বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদের অবশ্য ঈদের শুরু-শেষ বলে কিছু ছিল না। দিনভর ছুটোছুটিই করতে হয়েছে। ক্রিকেটাররা কখন, কোথায় ঈদের নামাজ পড়ছেন, বিশেষ কোনো আয়োজন আছে কি না, ঈদের দিনটি তারা কিভাবে কাটাচ্ছেন, সব মিলিয়ে ক্রিকেটারদের ঈদ উদযাপনের খবর সংগ্রহের চেষ্টায় সংবাদকর্মীদের নিজেদের ঈদের তেষ্টা মেটানো আর হয়ে ওঠেনি।
টিম হোটেলের বাইরে সাংবাদিকদের অপেক্ষা ছিল সকাল থেকেই। পরদিন নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ। সেই ম্যাচ নিয়ে হোটেলের সামনেই সংবাদ সম্মেলন দুপুর ১২টায়। দুপুর ২টা থেকে নিউ জিল্যান্ড দলের অনুশীলন ওভালে, সন্ধ্যায় ৬টা থেকে বাংলাদেশ দলের। বিস্তৃত ব্যস্ততায় সাংবাদিকদের একটি বেলা ঈদের আমেজে কাটানোর ফুরসত কোথায়!
সকালে হোটেলের বাইরে অপেক্ষার সময়টুকুতেই তাই ঈদের আবহ আনতে হলো। ইংল্যান্ডে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ কাভার করার পর এবারও এখানে বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা সিনিয়র সাংবাদিক আরিফুর রহমান বাবু তার হোটেল থেকে সঙ্গে করে এনেছিলেন সেমাই। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়েই এক-দুই চামচ সেমাই খেয়ে ঈদের সকালের স্বাদ পেলেন সবাই।
একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধি হয়ে আসা ফারজানা জহির হঠাৎ ঘোষণা করলেন, “এতগুলো ভাইয়ের মাঝে আমি একমাত্র বোন, আমাকে সেলামি দিতে হবে।” ভাইয়েরা বললেন, “সালাম না করলে সেলামি নাই!” ফারজানাও কম যান না, ঝটপট সালাম করে বসলেন সংবাদকর্মীদের এই বহরের প্রিয়মুখ মোহাম্মদ সাইদুজ্জামানকে। ক্যামেরার ঝলকানি আর তুমুল করতালিতে সেলামি উঠল ফারজানার হাতে। জীবনে প্রথমবার সেলামি পেলেন তিনি পাউন্ডে!
ঈদ নামাজ একসঙ্গে সবার পড়ার সুযোগ না হলেও ‘ঈদ মোবারক’ জানিয়ে কোলাকুলি চলল সবার। কাছেই দাঁড়ানো হোটেল ও আইসিসির নিরাপত্তাকর্মীদের বিস্মিত চাহনির ভাষাটা ছিল পরিষ্কার, “এই লোকগুলোর তো প্রতিদিনই দেখা হয়, আজকে আচমকা কী হলো!” তারা কী আর বুঝবেন, ক্রিকেট নামক পেশা ও নেশায় ডুব দেওয়া মানুষগুলোর ঈদ ওইটুকুই!
সেই ঈদ, এই ঈদ
বাংলাদেশে ঈদ বুধবার নাকি বৃহস্পতিবার? গতকালকের সবচেয়ে আলোচিত এই প্রশ্ন ক্রিকেট অনুসারীদের অনেকের কাছে ছিল হয়তো এভাবে, ‘বাংলাদেশের খেলা ঈদের দিন নাকি ঈদের আগের দিন?’
বাংলাদেশ দল তখনও পায়ের নীচে শক্ত জমিন পেতে ধুঁকছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জয়ের দেখা নেই ততদিনে টানা সাড়ে তিন বছর ধরে। সামনে যখন আইসিসির সহযোগী দেশ কানাডা, জয়টা ধরে নেওয়া হয়েছিল অবধারিতই। ঈদ আনন্দের আগে আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয় খরা কাটার খুশি, রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষা ছিল অনেকের। সেই অপেক্ষা পরে রূপ নিল দুঃস্বপ্নের বিষাদে। কানাডাকে ১৮০ রানে আটকে গিয়েও হেরে গেল বাংলাদেশ ৬০ রানে!
সেই ম্যাচে খেলা একজনই কেবল আছেন এবারের বিশ্বকাপ দলে। কানাডার বিপক্ষে সেই ম্যাচ দিয়েই চোট কাটিয়ে প্রায় দেড় বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছিলেন মাশরাফি মুর্তজা। ফেরার ম্যাচে নিয়েছিলেন দুটি উইকেটও। কিন্তু দলের পারফরম্যান্সে ম্যাচটি ছিল ভুলে যাওয়ার মতো।
ক্রিকেট ম্যাচের আগে ফুটবলের ছোঁয়া
পর দিন ক্রিকেট বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ, কিন্তু বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে ব্যাট-বলের তুকতাকের চেয়ে ফুটবলের কারিকুরিই হলো বেশি!
সেটি বাধ্য হয়েই। দল মাঠে এসেছিল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। দুপুরে নিউ জিল্যান্ড দল অনুশীলনের মাঝপথে মাঠ ছেড়ে ছুটতে বাধ্য হয়েছিল বৃষ্টির হানায়। বাংলাদেশ দলও অনেকটা সময় হয়ে রইল বৃষ্টিবন্দি। ইনডোরে খানিকক্ষণ অনুশীলন করলেও খুব লম্বা হয়নি সেই সেশন। পরে বৃষ্টি একটু ছুট দেওয়ার পর গা গরমের পালা চলল ফুটবলে পা চালিয়ে।
ক্রিকেটোরদের ফুটবল স্কিলও খারাপ নয় খুব একটা। এখানেও দলের অন্যতম সেরা সাকিব আল হাসান। ছেলেবেলায় যে ফুটবলই বেশি পছন্দ করতেন, সেটির ছাপ এখনও দেখা যায় তার পায়ের কাজে। দারুণ খেলেন মাহমুদউল্লাহ, এখন দলের বাইরে থাকা নাসির হোসেনও। খুব পিছিয়ে নেই মাশরাফি মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম।
তবে কয়েকটি ইনজুরির ঘটনার পর ফিজিও-ট্রেনারের পরামর্শে ফুটবল ম্যাচ এখন আর গত কিছুদিন ধরে খুব একটা হচ্ছে না। এখন ফুটবল দিয়ে গা গরম করা হয় ‘চোর চোর’ খেলে। বৃষ্টির ছোবলে সোমবার এই খেলাতেই বেশির ভাগ সময় পার করতে হয়েছে ক্রিকেটারদের।
অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই ওভালে একসময় ফুটবলও হতো নিয়মিতই। ইতিহাসের প্রথম প্রতিনিধিত্বমূলক ফুটবল ম্যাচটি এই মাঠেই হয়েছিল ১৮৭০ সালে, ইংল্যান্ড মুখোমুখি হয়েছিল স্কটল্যান্ডের। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ফুটবল প্রতিযোগিতা, এফএ কাপের প্রথম ফাইনাল ১৮৭২ সালে হয়েছিল এখানেই। পরে এখানে বসেছে আরও অনেক আসর, বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেই মাঠেই বৃষ্টির দিনে বাংলাদেশ দলের ফুটবল চর্চা চলল ‘চোর চোর’ খেলে।