ঈদে বাড়ি ফেরা হয় না তাদের

আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ কয়েক দশকে ঈদে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন মাত্র তিন-চারবার। নানা কারণে এবারও অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেন নি। তাই ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণভাবে রাঙাতে পারেনা তাদের।

জাহাঙ্গীর কবীর বাপপি, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2022, 02:20 PM
Updated : 5 May 2022, 02:20 PM

আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সোমবার অনুষ্ঠিত হয়েছে রোজার ঈদ। দেশটিতে এবার সরকারি খাতে ঈদের ছুটি ছিল ৯দিন। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের ছুটি দিয়েছে ৫দিন।

আমিরাতে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদে।

কোভিড সংক্রমণের কারণে দেশে যাওয়া আটকে থাকার পর এই ঈদে সে জট খুলেছে। দীর্ঘ ছুটির সাথে বার্ষিক ছুটির দিনগুলো যোগ করে যারা পেরেছেন ছুটে গেছেন পরিবার-পরিজনদের সাথে ঈদ করতে দেশে।

পরিচ্ছন্নতা কর্মী সবুর আলী ও মোহাম্মদ বাদশাহ

প্রবাসীদের কেউ কেউ আমিরাতের বিভিন্ন প্রদেশে কিংবা আমিরাতের বাইরে প্রতিবেশী দেশগুলোয় আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবদের সাথে ঈদ করতে গেছেন। কোভিড-১৯ এ নিস্পন্দ-নিরানন্দ দুই ঈদের পর এবার নতুন প্রাণের উদ্যমে প্রাণস্পন্দনে ভরপুর ছিল ঈদের দিনটি।

ব্যাচেলর পাড়ার অনেকেই বাড়তি বিমান ভাড়ার কারণে দেশে যেতে না পারলেও, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঈদের নামাজ জামাতে পড়ে, দিনান্তে বাংলাদেশী অ্যাসেম্বলি পয়েন্টগুলোয় বন্ধুদের সাথে প্রাণবন্ত আড্ডায় মেতে, প্রবাসে স্বজনবিহীন ঈদ কাটানোর বেদনা ভুলতে চেষ্টা করেছেন। কেউবা আবার অন্য সব দিনের মতো ঈদের দিনও কাজে ছুটে গেছেন।

তবে বাড়ি ফিরতে না পারার বেদনা কাজ করেছে প্রায় সবার মধ্যেই। তেমনই একজন কিশোরগঞ্জের সবুর আলি। ১১ বছর ধরে আবুধাবি আছেন। কাজ করেন ভবন মেরামতের।

দেশে শেষ কবে ঈদ করেছেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১১ বছর দেশেই যাওয়া হয়নি- ঈদ আর কখন করলাম! ঈদের দিন কাজ করছি। আমাদের আবার ঈদ। ঈদের দিন বাবা-মা-ভাই-বোনদের কথা খুব মনে হয়।”

ইশতিয়াক হোসেন

তার সহকর্মী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মোহাম্মদ বাদশাহ ১২ বছরে মাত্র ৪ বার দেশে গিয়েছেন। এরমধ্যে পেয়েছেন দুইটি ঈদ। তিনি বলেন, “ঈদে দুই ছেলে, মা, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজনদেরকে দেখতে মন চায়। সবার কথা মনে পড়ে। সবাই মিলে একসাথে ঈদ করার আনন্দের সাথে কোনও কিছুর তো তুলনা হয় না।”

দুই বছর পর দেশে ঈদ করার ইচ্ছার কথা জানালেন বাদশা।

চট্টগ্রামের প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশতিয়াক হোসেন বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসায় দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে হাল ধরেছেন আবুধাবিতে। সপরিবারেই বসবাস করেন এখানে। শিক্ষা ও কর্মজীবন মিলিয়ে ৪০ বছর ধরে আছেন প্রবাসে। এত দীর্ঘ সময়ে দেশে ঈদ করেছেন মাত্র দুইটি।

তিনি বলেন, “রোজার ঈদ যাই হোক না কেন, কোরবানির ঈদ দেশে করার আনন্দই আলাদা। পুরো জীবন তো এখানেই কেটে গেল, ঈদ এলে দেশের আত্মীয়-পরিজন বন্ধু-বান্ধবদের কথা মনে পড়ে। আমার বাড়ি সীতাকুণ্ডের ঈদ মেলার কথা মনে আছে খুব। ঈদে মুরুব্বিদের কাছ থেকে পাঁচ-দশ টাকা সেলামি পেতাম, তাতে ছিল কতো সুখ!"

প্রবাসী ব্যাংকার মশিউর রহমানের বাড়ি নাটোর। ১৫ বছর ধরে আরব আমিরাতে আছেন।

এই দীর্ঘ সময়ে দেশে চার-পাঁচটা ঈদ করেছেন। দেশে ঈদ উদযাপনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, "দেশতো দেশই। নামাজে যাওয়ার আগে বাবা-মাকে সালাম করতাম, সেলামি মিলতো। বন্ধুরা দলবেঁধে বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যেতাম। কতো মজার ছিল সব।"

মশিউর রহমান (সাদা পাঞ্জাবি)

"এখানে আমিরাতে ঈদের নামাজ হয় অনেক সকালে। নামাজের পর অত ঘোরাঘুরি করা হয়না, ক্লান্ত থাকি। দুপুরের দিকে অতিথিরা আসেন, তাদের সাথে সময় কাটাই। বাচ্চাদের ঈদ যেন আরও বিবর্ণ ঈদ। চারদেয়ালের মধ্যে বন্দি ঈদ। ওদের নিয়ে শপিং মলে যাই। সেখানে চিত্রাঙ্কন, কুইজ প্রতিযোগিতা হয়, যতটুকু পারে ওরা আনন্দ করে। কিন্তু আমাদের শৈশবের ঈদের মতো ওদের ঈদ তেমন আনন্দের হয় না।"

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন ফেনীর কাজী সুলতান মাহমুদ। শিক্ষা ও কর্মজীবন মিলিয়ে ৩৭ বছর ধরে আবুধাবিতে আছেন।

তিনি জানান, আশির দশক থেকে ৮ থেকে ১০টা ঈদ মাত্র দেশে করেছেন। নানা কারণে দেশে আসা হয় না।

ঈদের স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, “আমার জন্ম পুরান ঢাকার কলুটোলায়। দেশের ঈদের আনন্দ বলতে আসলে শৈশবের ঈদকেই বেশি মনে হয়। বাবা প্রতি ঈদের আগের রাতে একটা খেলনা কিনে আনতেন। মা রাত আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত জেগে ঈদের মিষ্টি, সেমাই, হালিম রান্না করতেন। পুরোনো হয়ে যাবে বলে আমরা ঈদের জামা লুকিয়ে রাখতাম, সকালে বাবা চাচাদের সাথে বায়তুল মোকাররম মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম।”

কাজী সুলতান মাহমুদ

“২৬/২৭ জন মামাতো-চাচাতো ভাইবোনরা বড় দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যেতাম। ঈদি পেতাম। আহা কতোই না মজার ছিল দিনগুলো! প্রবাসের ঈদ অসম্পূর্ণ ঈদ।দেশের ঈদের আনন্দ অনুভূতি এখানে নেই। তারপরও বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় বেড়াতে যাই। দুবাইয়ে কিছু আত্মীয়-স্বজন আছেন, তাদের সাথে সময় কাটাই।  এইতো এভাবেই কাটে ঈদ।”

আরেক প্রবাসী মো. শাহাবুদ্দিনের বাড়ি চট্টগ্রাম। তিনি একটি ফেব্রিক্স হাউজের বিপণন কর্মী হিসেবে ১৩ বছর ধরে আমিরাতে আছেন। তিনি জানান, ‘ব্যবসার মওসুম হওয়ায়’ প্রবাসে থাকাকালে দেশে একটাও ঈদে তিনি যেতে পারেন নি। তাছাড়া সামান্য বেতন, বিমান ভাড়াও অনেক। হাতে এতো চড়া বিমান ভাড়া দেওয়ার মতো জমানো টাকা নেই দেশে যাবেন। মিরেরশ্বরাইয়ের জোরারগঞ্জের বাড়িতে স্ত্রী আর কন্যা রয়েছে তার।

তিনি বলেন, “বাড়ি যেতে পারলে ঈদটা ভাল হতো। কিন্তু যাবোটা কী করে?"

মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন

প্রবাসী আফসানা রহমানের আবুধাবির বাসায় ঈদের দিন এসেছিলেন তার তিন বান্ধবী ফাতিমা আক্তার, উম্মে কুলসুম এবং সীমা শারমিন। কথা হলো তাদের সাথেও।

ফাতিমা ১৬ বছর ধরে আবুধাবি আছেন। বাড়ি সিলেটের মীরা বাজার। তিনি জানান, দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ের মধ্যে  দেশে কেবল দুই-তিনবার ঈদে আসতে পেরেছেন।

তিনি বলেন, “ঈদ এলে দেশে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, ভাই বোন বাবা মা সবাইকে নিয়ে ঈদ করার আনন্দকে মিস করি। প্রবাসে ঈদ বলতে ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস আর বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোই। দেশে ও প্রবাসে দুই জায়গায় ঈদের আনন্দ দুই ধরনের। বাবা-মা আমেরিকায় থাকেন, তাই ঈদে দেশকে তেমন করে মিস করি না এখন।”

আবুধাবি প্রবাসী চট্টগ্রামের উম্মে কুলসুমের গত ১৬ বছর প্রবাস জীবনে কেবল একবারই দেশে ঈদ করা হয়েছে। বললেন, “এবারো ঈদে দেশে ঈদে যাওয়া হতে হতে হয়ে উঠলো না। আগে আবুধাবিতে আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই ছিলেন, তাই এখানে দেশের ঈদের আমেজটা পেতাম। এখন ঈদ এলে তাই দেশকে বেশি মনে পড়ে। আসলে দেশে ঈদের আনন্দটাই আলাদা। যতই বলি দেশের ঈদকে প্রবাসে খুঁজে পাওয়া যায় না।”

রাজশাহীর মেয়ে ব্লগার ও রন্ধনশিল্পী  আফসানা রহমান ৬ বছর ধরে প্রবাসে আছেন। এ সময়ে চারটি কোরবানির ঈদ দেশে করেছেন।

(বাম দিক থেকে)  আফসানা রহমান, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা আক্তার।

তিনি বলেন, "দেশে বাবা-মা ও ফ্যামিলির সাথে ঈদ করার আনন্দের তুলনা কি হয়? ছোটবেলায় দলবেঁধে চাঁদ দেখা, হাতে মেহেদি লাগানো, ক্লোজ ফ্রেন্ডদের সাথে ঘোরাফেরার মজাই আলাদা ছিল। এখন সংসার হয়েছে, ঈদ এলে অনেক দায়িত্ব এসে পড়ে। তবুও চেষ্টা করি বন্ধুদের সাথে যতটা পারি ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। তবে আফসোস হয়, যখন দেখি আমাদের বাচ্চারা প্রবাসে আমাদের শৈশবের মতো ঈদের আনন্দকে পাচ্ছে না।"

ছবি: জাহাঙ্গীর কবীর বাপপি

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!