সুইডেনে যাপিত জীবন এবং পরিবেশ সচেতনতার নানা গল্প

পরিবেশ দিবস চলে গেল। দেশে থাকতে দৈনন্দিন জীবনে পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করে বাঁচার নিয়মতান্ত্রিক এবং রাষ্ট্রিক কোনও উদাহরণের সম্মুখীন হইনি। অথচ সুইডেন প্রবাসে যাপিত জীবনের প্রতি ক্ষণে ক্ষণেই তার প্রমাণ পাই। এ লেখাটি কেবলই প্রবাস জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য। 

রাবেয়া মীর, সুইডেনের স্টক;হোম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2021, 08:26 PM
Updated : 5 June 2021, 08:26 PM

একদিন আমার দশ বছরের বাচ্চা মেয়েটি স্কুল থেকে ফিরেই বাসায় সেদিনের জমে থাকা ময়লা আলাদা আলাদাভাবে জমা করে নির্দিষ্ট করে বাক্সে ফেলতে লাগলো। বিভিন্ন বর্জ্যের বাক্স বলতে কাগজ, প্লাস্টিক, খাবারের উচ্ছিষ্ট, ইলেকট্রনিক তার, ব্যাটারি ইত্যাদি ফেলার আলাদা আলাদা বাক্স। এ বাক্সগুলো এখানকার রান্নাঘরে সারিবদ্ধভাবে, বিশেষ করে পানিকলের বেঞ্চের নিচে সাজানো থাকে।

মেয়েটি আমার শুধু সেগুলো করেই থেমে যায়নি, খেয়াল করে দেখছে আমরা ঠিক বাক্সে ঠিক বর্জ্য ফেলেছি কিনা। ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল।

আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “খুব ভালো কাজ করছো। কিন্তু কী ব্যাপার, আজ বাসার ময়লাগুলো আলাদা আলাদা করে ফেলার প্রতি তোমার আগ্রহ?”

ও বলতে লাগলো, “মা, এগুলো একসঙ্গে ফেললে পরিবেশ ভাল থাকবে না। । আর এক সময় আমাদের বিভিন্ন দেশ পানির নিচ চলে যাবে, খুব ভয়ের না মা?”

বুঝতে দেরি হলো না, স্কুলে পরিবেশ সম্পর্কে শেখানো হচ্ছে, প্রতিদিনের ময়লাগুলো যেখানে-সেখানে না ফেলে কিভাবে কোথায় ফেলা যায়।

বাসাবাড়িতে

প্রথম যখন এ দেশে এসেছি, ছাত্রাবাসে থাকতাম। অনেক কিছুই নিজ দেশ থেকে আলাদা বলে চোখে পড়তো। এর মধ্যে, একটি হলো, রান্নাঘরে বিভিন্ন ময়লা বিভিন্ন বাক্সে ফেলা। ঘরে জমানো ময়লাগুলো ফেলার জন্য বাসার বাইরে একটু দূরে বড় বড় বাক্স থাকে। পরে একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে ময়লা সংরক্ষণকারীরা ময়লার গাড়ি নিয়ে এসে নিয়ে যায়। এটা সপ্তাহে এক বা দুইবার হয়। এখানকার সকল মানুষ মোটামুটি এভাবে বাসাবাড়ির ময়লা ফেলে অভ্যস্ত | তবে বাইরের দেশ থেকে যখন কেউ সুইডেনে আসেন, এ অভ্যাসে আসতে তাদের সময় লেগে যায়।

বাড়ির ভেতরে নির্দিষ্ট বর্জ্য ফেলার জন্য আলাদা আলাদা বক্স।

একটি ঘটনা বলি। স্টকহোমের বিভিন্ন এলাকায় আমার থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। একবার ইউরডব্রু নামক একটি জায়গায় বাসা নিলাম। শুনলাম ওই এলাকায় যাদের বসবাস তাদের রাজস্ব বেশি দিতে হবে। কারণ ওই এলাকায় বাইরে থেকে আসা লোকজন বেশি থাকে এবং তারা বর্জ্য আলাদা করে ফেলাটা ভালোভাবে অনুসরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। তাই পরে সরকারের বর্জ্য আলাদা করতে হয় এবং অতিরিক্ত খরচ পড়ে। এ এলাকার মানুষকে বেশি রাজস্ব দিতে বাধ্য করে, এভাবে জগাখিচুড়ি অবস্থায় বর্জ্য ফেলতে নিরুৎসাহিত করা সম্ভব বলে সরকার মনে করে।

যদিও সুইডেনে দেখেছি বড় কোনও উৎসব হলে সাধারণ জনগণ বিভিন্ন পানীয়ের কাঁচের বোতল ভেঙে রাস্তায় ফেলে রাখে, যা পরের দিন লোকবল নিয়োগ করে সরকারকে পরিষ্কার করতে হয়। ভাঙা কাচ রাস্তায় চলার সমস্যা করে এবং পরিবেশের ক্ষতি করে। এ কাজে ব্যবহৃত গাড়ি থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস বাতাসে আসে।

বাজার ও শপিং মল

বেশ কয়েকমাস আগে একটি টি শার্ট কিনে দাম দিতে গিয়ে একটি পলিথিন ব্যাগ নিতে গিয়ে দেখলাম হাতের কাছে কোনও ব্যাগ নাই। কোনো কিছু কেনার সময় পলিথিন ব্যাগও তুলে নিতাম। এখন আর দেখছি না। অপেক্ষা করছি, দেখি, ক্যাশিয়ার কী বলেন।

উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাগ লাগবে কিনা? আমি বললাম, লাগবে। দেখছি, ডেস্কের নিচ থেকে কাগজের ব্যাগ বের করছেন। আর একটি কাগজের ব্যাগের দাম পলিথিন ব্যাগের চেয়ে তিনগুণ বেশি।

বুঝতে পারলাম পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিধায় এ পরিবর্তন করা হয়েছে। তাছাড়া কাগজের ব্যাগও যে হাতের নাগালের বাইরে রাখা হয়েছে এর কারণ লোকজন  যেন নতুন ব্যাগ না কিনে বাসার থেকে পুরনো ব্যাগ নিয়ে আসেন। কয়েকদিন পর দেখলাম লোকজন পুরনো ব্যাগ বাসার থেকে নিয়ে আসতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

বাস ও ট্রেনে

বাস বা ট্রেনে উঠলেই দেখা যায় দরজার কাছাকাছি ময়লা ফেলার বাক্স থাকে। এ বাক্সগুলোতে সাধারণত কাগজ, প্লাস্টিক বা ফলের খোসা এ জাতীয় ময়লা বেশি ফেলা হয়। এ ধরনের বর্জ্যগুলো একই বাক্সে ফেলার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু অন্য কোনও রকম বর্জ্য যেমন ইলেকট্রিক তার বা ব্যাটারি এসব এ বাক্সগুলোতে ফেলা নিষেধ।

বন, পার্ক, নদীর পাড় ও রাস্তার ধার

রাস্তার পাশে বই রাখার তাক।

বনে ও পার্কে মানুষ হাঁটে, দৌড়ায়, কখনো বা বেঞ্চে বসে সময় কাটায়| হাতে কোনও বর্জ্য, যেমন ব্যবহৃত টিস্যু বা ফলের অবশিষ্ট অংশ কোথায় ফেলা যায়, চিন্তা করতে হয় না। কিছুদূর পর পর বর্জ্য ফেলার বাক্স। ঠিক একই রকম ব্যবস্থা রাস্তার ধার ও নদীর পাড়গুলোতেও। তবে একেবারেই প্লাস্টিক বোতল, টিস্যু বা প্লাস্টিক ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা যায় না, তা না। এরকম পড়ে থাকতে দেখা গেলে অস্বাভাবিক মনে হয়। কেউ কি অজান্তে বা অবহেলায় ফেলেছে? এ প্রশ্নটা মাথায় আসে|

গাড়ির হর্ন বাজানোর বাতিক নাই

একটি ব্যাপারে আমি অবাক হয়েছিলাম। সুইডেনে আসার পর এক বছরের মধ্যে যখন গাড়ির কোনও রকম হর্ন শুনি নাই। একদিন শুধু দেখেছিলাম এক গাড়িচালক একটি হর্ন বাজিয়েছিলেন তাও আবার আরেকজন চালক রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ভুল করেছিলেন বলে!

আনন্দে মাতোয়ারা বাড়ির আওয়াজ

ছাত্রাবাসে যখন থাকতাম, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীরা সাপ্তাহিক ছুটিতে রাত দশটার পর থেকে প্রায় ভোর পর্যন্ত পার্টি করতো। সেখানে অনেক গান-বাজনা, নাচ, গল্প বেশ আওয়াজের সঙ্গে হতো। কাজের দিনগুলোতে রাত আটটার পর সাধারণত কোনো রকম আওয়াজ কেউ করেন না। কারণ পরের দিন সবার কাজ আছে, আগের রাতে সবাইকে ঘুমাতে হবে।

একটা গল্প বলি। আমার ছেলে লুব্ধক যখন আমার গর্ভে, তখন একদিন রাত দুইটা পর্যন্ত ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, ঘুমাতে পারছি না। পাশের রুমে ভীষণ আওয়াজ, গান-বাজনা হচ্ছে। পরে মনে হলো বলি আমার অবস্থাটা। দরজায় টোকা দিয়ে বললাম, আমি ঘুমাতে পারছি না, শব্দের জন্য। ওরা বুঝতে পেরে আওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছিল।

আরেকটা জিনিস ভালো লাগতো, ছাত্রাবাসে যদি কোনো ছাত্র পার্টি করতো, তাহলে দুই তিন দিন আগে থেকেই একটা ছোট বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিতো, যে তার একটা পার্টি হবে, ওই দিনে। তাহলে অন্যরা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারতো যে, সেদিন আওয়াজ হতে পারে। অপ্রয়োজনীয় বিকট শব্দ অনবরত না হলে, মানুষ সুস্থ থাকে বেশি, কারণ অপ্রয়োজনীয় শব্দ বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের ঘুমের ক্ষতি করে বা দিনের বেলায় বিরক্তি তৈরি করে ।

কারখানা ও গবেষণাগারে

কারখানায় এবং গবেষণাগারে রাসায়নিক বর্জ্য সংরক্ষণ করে রাখার জন্য বড় বড় বাক্স থাকে ওখানে। বাক্সগুলো বিভিন্ন রঙের ও নামের হয়| বাক্সের গায়ে বিভিন্ন বিপদজনক চিহ্ন দেওয়া থাকে, যাতে যারা কাজ করেন তারা সহজে বুঝতে পারেন, কোথায় কী ফেলতে হবে। চিহ্ন থেকে এও বোঝা যায়, বর্জ্য ফুসফুস বা চামড়ার জন্য ক্ষতিকর কিনা, যাতে ফেলার সময় কর্মীরা সাবধান থাকেন। পরবর্তীতে ময়লা সংরক্ষণকারীরা সপ্তাহে দুই বা একবার এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যান|

রাস্তার পাশে ও কফিশপে খোলা বইয়ের তাক

একবার রাস্তার পাশে খোলা বইয়ের তাক দেখে প্রথমে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভাবলাম, নতুন-পুরোনো বইগুলো কি কেউ বিক্রি করছেন? একটু কাছাকাছি গিয়ে দেখি কেউ কেউ তাদের পুরোনো বই রেখে যাচ্ছেন, আর কেউ আবার পছন্দ অনুযায়ী বই বাছাই করে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে একই রকমের বই উৎপাদন দরকার হচ্ছে না। আবার একই বই দিয়ে অনেক মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। মনে হলো অহেতুক গাছ কাটা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে এটির একটি ভূমিকা রয়েছে।

পুরনো কিন্তু পরিধানযোগ্য কাপড় অন্যদের জন্য রেখে যাওয়ার স্থান বা ‘ক্লাডব্যাংক’।

ঠিক এরকমটি দেখেছি, এখানকার বিভিন্ন বিপণীকেন্দ্রে। চা-কফির দোকানের পাশেই বইয়ের তাকের মতো আছে, যেখানে মানুষ পুরোনো বই রেখে যান। চা-কফি খেতে বসে থাকা মানুষ বই এর নামগুলোতে চোখ বোলাতে পারেন, ইচ্ছে হলে পাতা উল্টে দেখে ও পছন্দ হলে সাথে করে বইটি নিয়েও যেতে পারেন। এভাবে পুরোনো বইগুলো অন্যদের কাজে লাগানো হয়।

ক্লাডব্যাংক বা কাপড়ের ব্যাংক

কাপড় পুরোনো হয়ে ছিঁড়ে গেলে, বা জুতা ছিঁড়ে গেলে একটা আলাদা জায়গায় ফেলার ব্যবস্থা রয়েছে, সেটা জানতাম। কিন্তু রাস্তার পাশে সবুজ রঙের বড় বড় বাক্স যেখানে লেখা ”ক্লাডব্যাংক”, মানে কাপড়ের ব্যাংক, দেখে ভাবছিলাম, এগুলো কেন? শুনলাম, মানুষের ব্যবহার করা কাপড় বা জুতা, যা অন্য কেউ এখনও ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে হয়, এমন কাপড় লোকেরা ধুয়ে এখানে রেখে যান| পরে ‘ক্লাডব্যাংকে’র সাথে যুক্ত লোকজন এসে নিয়ে যান এবং অস্বচ্ছল দেশগুলোতে পাঠানো ব্যবস্থা হয়। শুধু তাই নয়, পুরনো জিনিসপত্র বিক্রির দোকানগুলোতে মানুষ পুরনো জামাকাপড়, অন্য জিনিসপত্র বিনামূল্যে দিয়ে যান এবং সেসব দোকানে এগুলোকে নামমাত্র দামে বিক্রি করা হয়। উপার্জিত অর্থ পরে সমাজে কোনও ভালো কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে করে পুরোনো জিনিসগুলো কাজেও লাগছে এবং অন্যরা তাদের পছন্দ মতো জিনিস কম দামেও পাচ্ছেন!

প্লাস্টিক বোতল ফেরত দিয়ে অর্থ পাওয়া

বিভিন্ন পানীয়ের বোতলে একটা নির্ধারিত মূল্য লেখা থাকে। বোতলগুলো ফেরত দিলে সে অনুযায়ী অর্থ ফেরত পাওয়া যায়। প্রত্যেক বাসায় প্লাস্টিক বোতল জমানো হয় এবং বেশ কিছু জমে গেলে বাজারে নিয়ে গিয়ে একটা মেশিনে একটি একটি করে ফেললে অর্থের রশিদ বের হয়ে আসে। এতে করে বাচ্চারাও বোতল জমা দিতে বেশ মজা পায়। বড় ছোট সবাই এভাবে পরিত্যক্ত বোতল পুনরায় জমা দিতে উঠে পড়ে লাগে।

প্রতিদিন জীবনযাপনের অনেক গল্প ও কথা ভিড় জমাচ্ছে। একটি কথা বলে শেষ করবো। ভালো লাগে যখন দেখি, গাড়ি থাকা সত্ত্বেও ভারী কিছু না কিনলে, লোকজন পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বাজার সদাই করতে গেলে, পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে করে যান| এতে দুইটা লাভ-  শরীর ভালো থাকে এবং গাড়ি থেকে অতিরিক্ত গ্যাস বাতাসে ছড়ায় না।

####

লেখক পরিচিতি: জন্ম ১৯৭৭, নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলায়, পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দ্রেসদেন বিশ্ববিদ্যালয়, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পোস্ট ডক্টরেট সম্পন্ন করেছেন জার্মানির দ্রেসদেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্টকহোমে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত।

লেখকের অন্য লেখা: