ইউরোপ যাওয়ার পর যেভাবে শিক্ষক হলাম

জার্মানির দ্রেসদেন বিমানবন্দরে নেমেই বুকটা প্রচণ্ড শূন্য শূন্য লাগছিল। গাল বেয়ে চোখের জল ঝরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলাম না। এদিকে চোখের জল মুছতে মুছতে পকেটে টিস্যুও শেষের পথে।

রাবেয়া মীর, সুইডেনের স্টকহোম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2021, 11:23 AM
Updated : 15 May 2021, 11:23 AM

দিনটি ছিল ২০০৬ সালের ৭ জুন। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছি - দুই পথের দিকে। আমার আড়াই বছরের কন্যা ও তার বাবা, আমার জীবনসঙ্গীকে রওনা দিতে হল অন্য একটি দেশে, আমাকে জার্মানির দ্রেসদেনের দিকে।

আমার এটি প্রথমবারের মতো ইউরোপে আসা। বিমানবন্দরে বহির্গমন অংশে একটি বেঞ্চে বসে আছি। পরিচ্ছন্ন বাইরে ঝলমল রোদ। কিছুক্ষণ পর পর লাল খয়েরি রঙের বাসগুলো এসে লোক নামিয়ে উঠিয়ে নিচ্ছে। আমার ফাঁকা লাগছে। কিছু ভাবতে পারছি না। সব সৌন্দর্য আমার চোখের মনোযোগের কাছে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। ভাবনায় আমার মেয়ের মুখ ছাড়া সামনে আর কিছুই দেখছি না!

দ্রেসদেনে আমি

আনমনে অপেক্ষা করছি এখানকার দুই গবেষণা সহকর্মীর জন্য। ওদের নাম ডারিনা ও ইনেস। ওদের সঙ্গে এখানে দ্রেসদেন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার গবেষণার কাজ করবো। আমার পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের নাম থমাস স্মিথ। তিনি মেইল করে জানিয়েছিলেন, ডারিনা ও ইনেস আমার কাছ থেকে গবেষণার উপাদান অর্কিড গাছ সংগ্রহ করতে আসবে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর ওরা দুইজন আসলো এবং অর্কিডগুলো নিয়ে ওরা সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেল। গাছগুলোকে দ্রুত গ্রিন হাউসে রাখতে হবে তাই।

ছোট বড় ভারী ব্যাগগুলো নিয়ে আমি টেক্সিতে রওনা দিলাম ভাষা ইনস্টিটিউটের উদ্দেশে । আমি যে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছি, এটি জার্মান শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (DAAD- Deutscher Akademischer Austaus Dienst) অংশ। এটির একটি শর্ত হলো, আমাকে চার মাস জার্মান ভাষা শিখতে হবে। ট্যাক্সি চলছে, বাইরে তাকিয়ে আছি। উদাসীন চোখ, কিছুই দেখছে না। অবশেষে ভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে এসে ট্যাক্সি থামল। গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন স্বদেশের এক ভাই, আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। আমার ভারী ভারী ব্যাগগুলো তিনি টেনে ওঠালেন|

ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরটা চমৎকার। পরিচ্ছন্ন। আপন আপন লাগল, বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের অবলীলায় বিচরণ দেখে। অফিসের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রওনা দিলাম ছাত্রাবাসের দিকে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সন্ধ্যা নেমে আসল। বুকে চেপে থাকা শূন্যতা আবার আমাকে ঘিরে ধরলো।

চোখের জল আবারো নিয়ন্ত্রণ হারাতে লাগলো। ফোনে খোঁজ নিলাম আমার মেয়ের। আমার বাচ্চা মেয়েটি বিমানবন্দরে এক ভদ্রমহিলাকে তার মায়ের মত দেখে মা মা বলে ডেকে কাছাকাছি গিয়ে মাকে না পেয়ে হতাশ হয়েছিল!

জার্মান ভাষা শেখার পালা

পরদিন থেকে জার্মান ভাষার ক্লাস শুরু। আমাদের ক্লাসে আমরা ১৬ জন শিক্ষার্থী ছিলাম, ১০-১২টি দেশের। এরমধ্যে আমরা চারজন বাংলাদেশের। চারজনের প্রত্যেকেই এদেশে পিএইচডি করতে এসেছি। ভাষা শিক্ষা শেষে প্রত্যেকে বিভিন্ন শহরে যার যার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবেন। প্রতিদিন বিভিন্ন আকর্ষণীয় কার্যক্রমের মাধম্যে নতুন একটি ভাষা শেখা ছিল আনন্দের। ক্লাস থেকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া ছিল পাঠদানের আরেকটা মজার অংশ।

দ্রেসদেন চমৎকার একটি শহর। আমি বলতাম, ট্রাম, গির্জা, নদী আর বাহারি রকম রুটির শহর। স্কুল শেষে বন্ধুরা মিলে ট্রামে ট্রামে ঘুরে বেড়াতাম শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথা। দল বেঁধে পড়াশোনা, এক সঙ্গে রান্না-বান্না, আড্ডা এসবে চলে যেত দিন। তবে দিন শেষে যখন সন্ধ্যা নেমে আসতো, রাতের নিস্তব্ধতায় মাতৃত্বের চাপা কান্নায় আমি আচ্ছাদিত হতাম।

এ বৃত্তির এক অদ্ভুত নিয়ম ছিল। ভাষা চলাকালীনে কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে তার বাচ্চা/স্বামী/স্ত্রীর থাকতে বা দেখা করতে আসা নিষেধ। তাই আমার স্বামী আর মেয়ে আমার এখানটায় আসতে পারেনি| অগাস্ট মাসে প্রথম আমি  ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাই। দুই মাস পর আমার সন্তানের সঙ্গে দেখা হওয়াটা যেমন ছিল মহা আনন্দের তেমনি ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কষ্টের। সন্তান থেকে দূরে থাকার এক অপরাধবোধের কষ্ট।

দেখতে দেখতে চার মাস পার হয়ে গেল। ভাষা শেখা শেষে ঢুকলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একই শহরে। তাই আমাকে পছন্দের এ স্মৃতিময় প্রিয় শহরটিকে ছেড়ে যেতে হলো না।

গবেষণার শুরু

শুরু হলো গবেষণার কাজ। থাকি ছাত্রবাসের দশ তলায়। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকে পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের পথ। পুরো ভবনজুড়েই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীরা থাকে।

তাদের আনাগোনা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। এদিকে আমার স্বামী ও মেয়ে প্রতিমাসে একবার কোনো এক সপ্তাহান্তে জার্মানিতে আসে আর আমি পরবর্তী মাসে কোনো এক সপ্তাহান্তে ভিন্ন দেশে ওদের ওখানে যাই। এভাবে চলছে আমাদের পরষ্পরের সাথে দেখা সাক্ষাতের পালা। আমাদের মাঝে বোঝাপড়া ভালো বলে দূরে থাকাটা আমাদের জন্য কাল হয়ে ওঠেনি বরং টান বেড়েছে। মেয়ে মা থেকে দূরে তার বাবার সঙ্গে একা থাকে বলে অনেকটা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। তার বাবা ঘুমিয়ে থাকলে সপ্তাহান্তের সকালগুলোতে নিজেই রুটি মাখন অথবা জেলি লাগিয়ে খেয়ে নেয়। শুনে চোখ ভিজে আসে।

দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া তিন ধরনের অর্কিডের ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করে তাদের মধ্যে জেনেটিক্যাল মিল খুঁজে বের করাই আমার গবেষণাকার্যের লক্ষ্য। অর্কিডগুলোকে দ্রেসদেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের গ্রিন হাউসে রাখা হলো যাতে উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে বেড়ে ওঠে। বাগানের মালিরা অর্কিডের বিশেষ যত্ন নিয়ে থাকেন। আমি বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী মূল ও পাতা সংগ্রহ করে আনি।

একবার আমার সব অর্কিড শুকিয়ে মরার পথে। ওই পরিবেশে অর্কিডগুলো খাপ খাওয়াতে পারছিল না। আমার খুব মন খারাপ। কড়া রোদে বাগানে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে আছি। ভেবে পাচ্ছি না, কি হতে যাচ্ছে। শুধু কষ্ট পাচ্ছি এটা ভেবে যে, গবেষণার উপাদান ঠিকমত না পেলে কাজ সম্পন্ন করতে দেরি হয়ে যাবে, ফলে পরিবার থেকে, নিজ দেশ থেকে আরও বেশি দিন দূরে থাকতে হবে। বাগানের পরিচালক বারবারা ডিশ আমার এ অবস্থা দেখে আমাকে বললেন, “আমরা সর্বোচ্চ যত্ন নেবো তোমার অর্কিডের। তুমি চাইলে আমাদের গার্ডেনে বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা অর্কিডগুলোও তোমার গবেষণা কাজে ব্যবহার করতে পারো।” বারবারার কথায় আমি ভরসা পেলাম।

আমার গবেষণাগারে আমিই একমাত্র আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী। বাকি সবাই জার্মান। চলছে গবেষণাকার্য। গবেষণার বেশির ভাগ সময়ই হতাশা আর নেতিবাচক ফলাফলে ভরপুর। তবে নেতিবাচক ফলও এক ধরনের প্রাপ্তি, যার উপর ভিত্তি করে সামনে এগোতে হয়।

গবেষণার কৌশলী আর গবেষক সহকর্মীরা একেকজন হয়ে উঠলো অতি আপন ও বন্ধুসম। ইতিবাচক কোনো ফল পেলে অধ্যাপক থমাস স্মিথ এর সঙ্গে আলোচনা চলতো এবং দেশের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক শেইখ শামিমুল আলমকে ফলাফল পাঠাতাম। সেদিন বিকেলবেলায় যখন গবেষণাগার থেকে বের হতাম, মনটা ফুরফুরে লাগতো।

পুনর্মিলন

বছরখানেক পার হয়ে গেল, এদিকে আমার স্বামী তার পড়াশোনা শেষ করে মেয়েকে নিয়ে জার্মানিতে চলে আসে। আমরা তিন জন এক সঙ্গে আছি, ২০০৭ এর মাঝামাঝি থেকে। ওরা আসাতে পাশের শিক্ষার্থী পরিবার ভবনের ছয় তলায় উঠি। মেয়েটা কিন্ডারগার্টেন শুরু করে আর ওর বাবা জার্মান ভাষা শেখার বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।

এখানে জীবন আরো মধুর হয়ে উঠলো | আমাদের ভবনে ও পাশের ভবনে আমার নিজ দেশের আরো কয়েকটি শিক্ষার্থী পরিবার থাকতো। আমাদের মধ্যে এক সময় এমন এক বন্ধন তৈরি হলো, আমরা ভুলেই গেলাম যে আমরা এক পরিবারের সদস্য নই। তারা স্নাতকোত্তর করতে আসে। তাদের প্রত্যেকের স্ত্রী একেকজন আমার বন্ধু ও ছোটবোন হয়ে উঠলো। সবাই আমাকে রাবেয়া আপা বলে, তুমি সম্বোধনে ডাকতো, যা আমাকে আন্দোলিত করতো।

প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় অঘোষিত পার্টি আমার বাসায়। এক সঙ্গে রান্নাবান্না ও আড্ডা চলতো গভীর রাত পর্যন্ত। ওরা আমাকে এতই ভালোবাসতো, আমাদের মেয়েটা কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে, আমার গবেষণার জরুরি কাজ থাকলে, ওরাই মেয়েটার যত্ন নিতো, যেন আমি আমার কাজটা শেষ করে আসতে পারি। আমার মেয়ে বাংলা লেখার হাতেখড়ি ওদের একজনের কাছে|

দেশে ফেরার বেলা

গবেষণা সফলতার সঙ্গে শেষ করে এবার দেশে ফেরার পালা। ২০০৮ এর সেপ্টেম্বর মাস। কষ্ট হচ্ছে এবার! গবেষণাগার, সহকর্মী, ওখানে থাকা দেশ বিদেশের বন্ধু-বান্ধব, মেয়ের বন্ধুবান্ধব ও তাদের বাবা মা যারা আমাদের বন্ধু বান্ধব হয়ে উঠেছে, ছাত্রাবাস, দ্রেসদেন ট্রেন স্টেশন, বিপণী কেন্দ্র, ট্রাম, পথ ঘাট এসবের জন্য। কিন্তু ভেতর থেকে নিজ দেশে ফিরে শিক্ষকতায় যোগ দেয়ার যে তাড়া অনুভব করছি তার কাছে এ কষ্ট মলিন হয়ে এলো! এবার আমি মেয়েকে নিয়ে  যাচ্ছি দেশে ফিরে। ততদিনে ওর বাবা ইউরোপের অন্য এক দেশে পিএইচডি শুরু করেছে।

এবার সুইডেন

দেশে ফিরে কলেজে যোগ দিলাম, মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করালাম| দিনশেষে  আমার স্বামী সোহেলের সঙ্গে ফোনালাপ। দিন চলে যাচ্ছে বেশ। কিছুদিনের মধ্যেই সোহেল অস্থির হয়ে উঠলো। সে চাইলো আমরা যেন সুইডেনে ফিরে যাই। ওর পক্ষে স্ত্রী-সন্তান থেকে দূরে থাকা সম্ভব না।

পিএইচডি শেষ করতে আরো চার বছর বাকি। আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। শেষে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম সুইডেনের দিকে। সেদিনটি ছিল, ৯ জুন, ২০০৯।  বিমানে উড়তে উড়তে ভাবতে লাগলাম, দূরে থাকলেও দেশকে মনে মনে বয়ে চলব|

পৌঁছে গেলাম স্টকহোম। সোহেল স্টকহোমের দ্যুরসলম নামক একটি জায়গায় থাকে। জায়গাটি মনোহর। বাড়ির পাশেই নদী। জুন মাস, গায়ে দোলা দিয়ে যাওয়া মিষ্টি হাওয়া ও রোদের  খেলা, ঘাসে ঘাসে বাহারি রকমের বনফুলেদের ছড়াছড়ি, রাস্তার পাশে বাড়িতে বাড়িতে আপেল গাছ, প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে মেলে ধরতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রকৃতির সঙ্গে নিরব সখ্যতা চলছে আমার। সাথে প্রকৃতির মতোই উদার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হলাম। ভালো লাগা তুঙ্গে।

অপরদিকে ভাবছি, ঘরে বসে থাকার মানুষ আমি নই। কিছু একটা করতে হবে! চাকরির জন্যে আবেদন শুরু করলাম সুইডেনে ও তার আশপাশের দেশে গবেষক অথবা শিক্ষক হিসেবে! এর মধ্যেই দ্বিতীয়বারের মতো মা হলাম। আমার পুত্রসন্তান আসলো পৃথিবীতে ২০১০ সালের মে মাসে। 

আবার জার্মানি

কিছুদিন পরই  খবর পেলাম আমার একটা চাকরি হয়েছে জার্মানিতে। পোস্ট ডক্টর গবেষক হিসেবে, গবেষণাগারে, যেখানে আমি পিএইচডি করেছি। এটি ছিল একটি জর্জ ফর্সটার হামবোল্ট   ফেলোশিপ। এ গবেষণা কাজটি দুই বছরের জন্য। জার্মানি পার্শ্ববর্তী  দেশ বলে, আমি ভাবলাম, আবারো যাওয়া যায় দুই  বছরের জন্য। আগের বারের মতো জার্মানি-সুইডেন, সুইডেন-জার্মানি বিমান সফর করে করে আমরা দুই বছর পার করে দেব।

এবার ছেলেকে নিয়ে সুইডেন থেকে ২০১১ সালের পয়লা এপ্রিল যাত্রা শুরু করলাম জার্মানিতে। ছেলের বয়স তখন ১১ মাস। ওকে ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে কাজ করাটা প্রথম দিকে আমাকে খুব কষ্ট দিত। ঠিকমতো বসতে পারতো না! কতদিন যে ডে কেয়ার সেন্টারের দরজা দিয়ে বের হয়েই চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরেছি। তবে পূর্ব পরিচিত শহর হওয়ার কারণে পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে বেশি সময় লাগেনি।

দ্রেসদেন শহরকেন্দ্রে বেসরকারি ভাড়া বাসায় থাকতে লাগলাম।

সুইডেনে ফেরার সময়

দু বছর কেটে গেল জার্মানিতে। এবার জার্মানিতে গবেষণা শেষে সুইডেনে ফেরার সময় হয়ে এলো। ৩১ মার্চ, ২০১৩ সালে ফিরে এলাম সুইডেনে। ছেলের বয়স প্রায় তিন। ও জার্মান এবং বাংলা দুই ভাষায়ই কথা বলে।

ভাবতে লাগলাম, বাচ্চারা ছোট ছিল, বেশ ছোটাছুটি হলো। এবার এক সঙ্গে থাকার পালা। সুইডেনকে বেছে নিলাম। সুইডেনকে ভালোবাসতে লাগলাম আমার দ্বিতীয় স্বদেশ হিসেবে।

এ দেশে শিক্ষক হবার পথে

এবার সুইডেনে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম! সিদ্ধান্ত নিলাম, শিক্ষকতা করবো। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে আর  ওদের সঙ্গ অসম্ভব ভালো লাগে আমার। শিক্ষার্থীরা যখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্লাসে শিক্ষকের পাঠদান শোনে এবং গ্রহণ করে, দেখে আপ্লুত হই, মুগ্ধ  হই। আমিও নিজেকে ভুলে গিয়ে হয়ে উঠি ওদের মতোই তরুণ।

সিদ্ধান্ত নিলাম, ১৬-১৮ বছর বয়সীদের পড়াবো। তারা এখানে দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে, যাদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহের বীজ বুনে দেব, যাদেরকে মুগ্ধ করবো একজন শিক্ষকের আদর্শ, সততা ও আচরণ দিয়ে। পাঠদানের পাশাপাশি জীবনের সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করবো, যা হয়তো কাউকে বদলে দেবে। আমার এ স্বপ্ন পূরণে আমাকে শিক্ষকতায় আসতে হলে প্রথমে শিখতে হবে সুইডিশ ভাষা। তারপর করতে হবে শিক্ষকতা বিষয়ক পড়াশোনা।

সুইডিশ ভাষা শেখার জন্য স্টকহোমে এসএফআই (বহিরাগতদের জন্য সুইডিশ) তে ভর্তি হলাম। জার্মান ভাষা কিছুটা জানা ছিল বলে সুইডিশ ভাষা শিখতে তেমন কষ্ট হয়নি। দেড় বছরে ভাষা সম্পন্ন করলাম এবং পাশাপাশি উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্নাতকোত্তর পড়াশোনা সম্পন্ন করলাম, এটির নাম চিকিৎসা-গবেষণা বিদ্যা। শিক্ষকতার জন্য এই পড়াশোনার দরকার নাই। নিজের জ্ঞান-পিপাসা মেটানোর জন্য করা।

শিক্ষাদান বিষয়ক পড়াশোনায় ভর্তির চেষ্টা চালাই। সেখানে ছোট একটি বাধা আসলো, আমাকে কিছু স্বতন্ত্র কোর্স করতে হবে, যতই আমি পিএইচডি ডিগ্রিধারী হই না কেন| সেগুলো হলো - সুইডেনের প্রাণী ও উদ্ভিদের উপর কিছু কোর্স। আমার দেশে সম্পন্ন করে আসা এ ধরনের কোর্স দিয়ে এখানে চলবে না। কারণ দুই দেশের বৈচিত্র্য ভিন্ন। শুরু হল স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী বিষয়ক বিদ্যা পড়া। সেখানে যারা পড়ছে, তারা আমার চেয়ে কমপক্ষে ১২-১৫ বছরের ছোট! কিন্তু আমি তাদের বন্ধু হয়ে মিশে গিয়ে স্টকহোমের বিভিন্ন পাহাড়ে পাহাড়ে, বন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর নাম শিখে নিলাম। সময়টি ২০১৬ সাল।

পাঠদান বিষয়ক পড়াশোনায় বেশ মজা পেলাম। আমাদের ক্লাসে মোট ১৬-১৭  জনের সবাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা, যারা সুইডেনে শিক্ষকতা করতে চাই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ দেশে শিক্ষক ছিলেন, কেউ কেউ নতুনভাবে শিক্ষকতায় আগ্রহী। এই পড়াশোনার একটা বিশেষ ধরন হচ্ছে, এখানে কার্যক্রমের মাধ্যমে কিভাবে ক্লাসে ছাত্রদেরকে যুক্ত করা যায় তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা বিশেষভাবে আমার মনোযোগ কাড়তো। তাছাড়া সহপাঠীদের মধ্যেও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে গভীর ধারণা নেওয়া ছিল আমার জন্য আরো বেশি পাওয়া। এই পড়াশোনা শেষ হল ২০১৮ সালে।

ভাবতে লাগলাম, শুধু জীববিদ্যা পড়াবো না, সঙ্গে রসায়নও পড়াতে চাই। কারণ এ দুই বিষয়ের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত মিল আছে তাতে করে রসায়নের গভীরতা দিয়ে জীববিদ্যাকে  ব্যাখ্যা করলে প্রাণবিজ্ঞানের  মজাটা ছাত্ররা সরাসরি পাবে। ভর্তি হয়ে গেলাম রসায়নে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। রসায়নের কোর্সগুলোও শেষ হলো ২০১৮-র মাঝামাঝিতে।

পুরনো স্বপ্নে নতুন করে ফেরা

এবার প্রস্তুত, এখানকার প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জীববিদ্যা আর রসায়ন পড়াতে। শিক্ষকতায় যোগ দেই ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে।

এখন ছাত্রদের নিয়ে ভাবি, স্বপ্ন দেখি, কিভাবে পড়ালে  ওদের জানার আগ্রহ বাড়বে, কতভাবে ক্লাসে বৈচিত্র্য আনা যায়। পাশাপাশি ওরা  কিভাবে একজন ভাল মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখবে, জীবনের সৌন্দর্য বুঝে উঠে- বলে উঠবে, "আমি সুখী মানুষ"। যখন আমার স্বপ্নে বাস্তবতার কোনো ছোঁয়া পাই, আমি যেন উচ্ছাসে আকাশে উড়ে বেড়াই।

আমি এখন স্টকহোমের ক্লরা সল্লেন্তুনা নামক একটি কলেজে  শিক্ষকতা করি। শিক্ষার্থীদের জীববিদ্যা, রসায়ন আর জীবপ্রযুক্তি পড়াই। তারাই আমার কাছে কেন্দ্রবিন্দু! আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমিতেও শিক্ষকতা করেছি, যেখানে শিক্ষার্থীদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। এখানেও তাই।

লেখক পরিচিতি: জন্ম ১৯৭৭, নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলায়, পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দ্রেসদেন বিশ্ববিদ্যালয়, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পোস্ট ডক্টরেট সম্পন্ন করেছেন জার্মানির দ্রেসদেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্টকহোমে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন