ভ্রমণ কাহিনি: লেক কোমোর সৌন্দর্য

মহামারীতেও পৃথিবীর কিছু কিছু জায়গায় সব নিয়ম-কানুন মেনে ভ্রমণ করা যায়। তবে সাবধানতা আবশ্যক। আমরা গিয়েছিলাম ইতালির লেক কোমোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

সহিদুল আলম স্বপন, সুইজারল্যান্ড থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2020, 08:20 AM
Updated : 21 Nov 2020, 08:20 AM

ব্যাপারটা ছিল এমন, আমাকে কিছুই না জানিয়ে জেনেভার পাঁচ তারকা হোটেল ‘লা রিসার্ভে’ আমার স্ত্রী তানিয়া আমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ ডিনারের সব ব্যবস্থা করে মহাসুখে গুনগুন করছে। আমিও কি কম যাই, অফিসে বসেই প্ল্যান তৈরি করে ফেলেছি। ইতালির ‘হোটেল ইম্পেরিয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’ এর রিসেপশনে ফোন করতেই ওপার থেকে ইতালিয় রিসেপশনিস্ট ফ্রান্সিস্কা ‘প্রোনতো’ (ইতালির ভাষায় হ্যালো) বলে জানালো, এ মহামারীর সময়ও তারা ক্লাইন্টদের কথা মাথায় রেখে হোটেল খোলা রেখেছে।

আমি বললাম আমার স্ত্রীকে সারপ্রাইজ ট্যুরে নিয়ে আসবো। ফ্রান্সিস্কা বললো, ‘একটা স্যুট এখনো খালি আছে। বেশ রোমান্টিক ভিউ। যদি তুমি চাও বুক করতে পারো।’ যেই বলা সেই কাজ, আমিও ‘তুতোবেনে গ্রাসিয়ে’ (ইতালিয় ভাষায় ঠিক আছে, ধন্যবাদ) বলে রিসার্ভ করে ফেললাম। ঘরে ফিরে একটু মেজাজ দেখানোর ভাব করে গিন্নীকে বললাম এখনো তোমার লাগেজ গুছানো হয়নি। গিন্নী আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আর চেহারায় গাম্ভীর্য রেখে আমি তার শিশুসুলভ চাহনি উপভোগ করতে লাগলাম।

আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় শহর ‘লেক কোমো’ দেশটির সুবিশাল তিনটি লেকের মধ্যে অন্যতম। লেক কোমো বা ইটালিয় ভাষায় ‘লাগো দি কোমো’ ইউরোপের গভীরতম হ্রদগুলোর অন্যতম জলাশয়। সুইজারল্যান্ডের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা শহরটির চারদিকে পাহাড়।

ইতালির লোম্বার্ডি শহরের সবুজ সৌন্দর্যময় পরিপাটি এ জায়গাটি দেখতে একেবারে ক্যানভাসের ছবির মতো। ইতালির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মিলান থেকে লেক কোমোর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। দেশটির রাজধানী রোমের সঙ্গে ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাগুলোর যোগাযোগের অন্যতম সংযোগস্থল কোমো।

লেক কোমো কেবল সৌন্দর্য আর আয়তনের কারণেই নয়, আভিজাত্যের কারণেও বিখ্যাত। লেকটি ঘিরে রয়েছে অনেকগুলো বাসা-বাড়ি। আছে অনেক প্রাসাদ ও ভিলা। রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে সেখানকার অভিজাতরা এ লেকের তীরে বানানো শুরু করেছিল অবকাশকালীন আবাস। এখনও এ লেকের তীরে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের তেমন বাড়ি আছে। বাড়ি আছে ম্যাথু বেলামির, রোনালদিনহোর, সিলভেস্টার স্ট্যালোনের, জুলিয়ান লেননের, বাড়ি আছে এমনি আরও অনেকের। মার্কিন পপসম্রাজ্ঞী ম্যাডোনা, ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী এলটন জনসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির অবকাশকালীন বাড়ি এ লেকের পাশে। হলিউড তারকা অভিনেতা জর্জ ক্লুনির বাড়ি এ লেকের তীরেই ।

আভিজাত্যের সুবাদে এ শহর বিখ্যাত, রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির নাগরিকরা এ লেকের পাশে তাদের আবাস বানিয়েছেন। লেক কোমোর একটি প্রাসাদের নাম ‘ভিলা দেল বালবিয়ানেলো’। এখানেই বিয়ে করেছেন বলিউড তারকা দীপিকা পাডুকোন ও রণবীর সিং। ‘স্টার ওয়ার্স’ ও ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এর মতো ছবিগুলোর শুটিং হয়েছে এখানে।

পুরো কমপ্লেক্সটিতে দুটি আবাসিক ভবন, একটি গির্জা এবং একটি পোর্টিকো রয়েছে যা একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা করেছে। ভিলা বালবিয়েনেলোর মূল দালানে কিছু ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ সাজসজ্জা পরিলক্ষিত হয়, যা ১৭ ও ১৮ শতকের কথা মনে করিয়ে দেয়। মহামারীর সময় ভিলার ভেতর প্রবেশে কিছুটা সংকুচিত করা হয়েছে।

তবে ভিলা দেল বালবিয়েনেলোর সুবিশাল ও মনোরম বাগান আপনি মন ভরে উপভোগ করতে পারবেন। আঠারো শতকের ‘ভিলা ওলান্দ্রা’ হলো অভিনেতা জর্জ ক্লুনির গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান। তিনি ২০০২ সাল থেকে কোমো লেকের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এ শান্ত গ্রামটি বেছে নিয়েছেন ছুটির সময় কাটাতে, কখনও কখনও অন্যান্য হলিউড সেলিব্রেটিদের সঙ্গে তাকে দেখা যায়। স্পষ্টত, জর্জ ক্লুনির উপস্থিতি লেগলিয়োতে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল যা এ এলাকায় হঠাৎ করে পাপারাজ্জিদের আনাগোনা এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে জর্জ ক্লুনির ভক্ত ও অনুরাগীদের জোয়ার ঠেকাতে একসময় সেনাবাহিনী মোতায়ন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। শেষে ক্লুনির গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এখানাকার সিটি কাউন্সিল একটি অ্যাডহক রেগুলেশন অনুমোদন দিয়েছে। এ বিধি-বিধান অনুসারে লেকের ধারে ভিলার প্রবেশদ্বারের আশপাশে পরিবহন নিষিদ্ধ, তবে এ আদেশটি লাগলিওর বাসিন্দাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

কোমোতে ৭০০ থেকে ১ হাজার বাংলাদেশির বসবাস। বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষত বার-রেস্টুরেন্টগুলোতেই তারা কাজ করেন। ইতালির অন্যান্য শহরের তুলনায় বেশ ভালো আছেন এখানকার বাংলাদেশিরা। এখানে করোনাভাইরাস বাংলাদেশিদের স্পর্শ করেনি বললেই চলে।

উত্তর ইতালির হিমবাহের এ হ্রদ কোমো, লম্বার্ডি রাজ্য, আল্পসের পাদদেশ আপনাকে দুহাত মেলে ডাকলে আপনি সাড়া না দিয়ে পারবেন না, যেমন পারিনি আমি আর আমার স্ত্রী।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!