বুর্জ আল আরাবিয়া, জান্নাত্তুদ্দুনিয়া সালালা, সালালা…

লেখার শিরোনামটি ওমানের খারিফ (বর্ষা) সংগীত। যার অর্থ- “আরবের গর্ব, দুনিয়ার স্বর্গ- সালালা”। খারিফ মৌসুমে সারা দিনরাত ওমান টিভি ও রেডিওতে এ সংগীত চলে। ওমানের দক্ষিণাংশের ধোফার প্রদেশে সালালা অবস্থিত। যার অধিকাংশ আগে ইয়েমেনের দখলে ছিল।

মো. ফারুক হোসেন, ওমান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2020, 05:44 PM
Updated : 30 Sept 2020, 05:44 PM

আর খারিফ অর্থ বর্ষাকাল। খারিফ মৌসুমে সারা দিনরাত কুয়াশার মত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়। আমাদের পরিচিত রিমঝিম বা ঝুমঝুম বৃষ্টি নয়। ছাতার প্রয়োজন নেই, আবার বৃষ্টিও আছে। ঝুমঝুম বৃষ্টি শুধু ঘূর্ণিঝড় বা সাগরের নিন্মচাপের সময় হয়, যা সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। আর খারিফ হচ্ছে আরবীয়দের রোমান্টিক বৃষ্টি। এ খারিফ হচ্ছে সালালা তথা ওমানের মূল সৌন্দর্য। খারিফ বৈশিষ্ট্যের কারণেই ওমান সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে স্বতন্ত্র।

মধ্যপ্রাচ্য বললেই মাথায় আসে মরুভূমি আর গরম চুল্লির তাপমাত্রার কথা। জুন-জুলাই মাসে মধ্যপ্রাচ্যে থাকে রেকর্ড পরিমান গরম। অথচ ওমানের সালালা অঞ্চলে এ সময়ে চলে খারিফ মৌসুম। যদিও ওমানের রাজধানী, মাস্কাট শহর অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশের মতই থাকে গরম চুল্লি। ব্যতিক্রম শুধুই সালালা। পুরো সালালা হয়ে উঠে সবুজ শ্যামল আর চতুর্দিকে প্রাকৃতিক ঝরনার হাতছানি। এ সময়ে এসির প্রয়োজনও শূন্যের কোঠায়। আরবীয়দের দেখা যায় গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালা খুলে হিমেল বাতাস আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির স্পর্শ নিতে। এ সময় সরকারিভাবে স্কুল-কলেজও বন্ধ থাকে। সবাই যেন মনভরে প্রকৃতিতে ডুব দিতে পারে।

পাশের দেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে শিশুদের বৃষ্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য রয়েছে কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা। চড়া মূল্যের টিকেট কেটেই বাবা-মা সন্তানদের সাথে বৃষ্টির পরিচয় করান। আর সালালাতে মেলে টানা দু-তিনমাস প্রাকৃতিক বৃষ্টির দেখা। এ সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায়? ফলে এ সময়ে আক্ষরিক অর্থেই সালালা থাকে টুরিস্টদের দখলে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসী নয়, ভিড় জমান ইউরোপীয়রাও। এমনকি ওমানের রাজধানী মাস্কাটের লোকজনেরও থাকে ব্যাপক সমাগম।

একটি তথ্য দিলে খারিফ মৌসুমের মহাত্ম্য কিছুটা হয়তো বোঝানো সম্ভব। সালালার বার্ষিক আয়ের ৮০ শতাংশ আসে এই সময়ে। অনেক ব্যবসায়ী আছেন শুধু এ তিন মাসেই ব্যবসা করেন বাকী নয় মাস করেন খারিফ মৌসুমের প্রতীক্ষা। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে খারিফ কেন্দ্রিক সকল অনুষ্ঠান উদযাপন ছিল নিষিদ্ধ। পর্যটক প্রবেশ এমনকি ওমানের অন্যান্য অঞ্চলের লোকজনও সালালা প্রবেশ করতে পারেনি। আবার যারা সালালায় আছেন, তাদের জন্যও পর্যটন স্পটগুলো ছিল নিষিদ্ধ। এসব জায়গায় ছিল একচ্ছত্র পুলিশের আধিপত্য।

নিষিদ্ধ শুনে অনেকের মনে হতে পারে- এ আর এমন কি! প্রবাসীরা না গেলেও ওমানিরা নিশ্চয়ই এসব জায়গায় যেতে পারে। আসল সত্যটা হচ্ছে- এখানে কেউ আইন অমান্য করার সাহস রাখে না। আইন ভঙ্গ করলেই মোটা অংকের ফাইন অথবা জেল। শুনে অবাক হলেও সত্য গত ছয় মাস ধরে রীতিমত আইন করে ওমানের সকল প্রার্থনালয়ে তালা ঝুলছে। মসজিদে নামাজ পড়া হচ্ছে না। গুটিকয়েক মন্দির, গির্জা যা আছে তাও তালাবদ্ধ। তবে মসজিদ থেকে আজান দেওয়া হচ্ছে শুধু এটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য, ‘সালাতের সময় হয়েছে, বাসায় সালাত আদায় করো’।

তবে মসজিদে প্রবেশের আইন প্রথমদিকে কোথাও কোথাও লঙ্ঘন হয়েছে। জেনে অবাক হবেন এই আইন অমান্য করার সাহস কোনও ওমানির হয়নি। কয়েক জায়গায় মসজিদে প্রবেশের জন্য জেলে গেছেন বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিরা। মধ্যপ্রাচ্যে মসজিদে প্রবেশের জন্য কাউকে জেলে যেতে হবে- এটা কেউ কখনো ভেবেছেন?

টানা ছয় মাস লক ডাউনের পর আবাসিক হোটেল, কফি শপ, রেস্তোরাঁ, সেলুন ইত্যাদি খোলা হলেও মসজিদ এখনো বন্ধ। জীবিকার তাগিদেই এগুলো খোলা হয়েছে। আসলে কোভিড-১৯ সবকিছু বদলে দিয়েছে। যাক, মূল প্রসঙ্গে যাই- কথা হচ্ছিল খারিফ সৌন্দর্য নিয়ে। এবার করোনাভাইরাসের কারণে এ সৌন্দর্যেও বসলো পাহারা। সন্ধ্যা থেকে সকাল অব্দি চলেছে কারফিউ। দুই ঈদ কেটেছে গৃহবন্দি অবস্থায়। তবে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যকে কি আর পুরোপুরি বন্দি করা যায়? কিছু বেয়াড়া ঝরনা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠিকই তৃষ্ণার্ত চোখের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। তবে কোথাও যেন মানুষ জটলা না বাঁধতে পারে সেদিকে পুলিশের সজাগ দৃষ্টি ছিল সবসময়।

ছয় মাস পর কিছু পর্যটন স্থল নির্দিষ্ট সময় ও সীমিত সংখ্যক মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

পরিবারের সবাই যেন এমন একটি আহ্বানের অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের বাড়ির পাশে দর্শনীয় প্রাকৃতিক ঝরনা ছিল আঈন আথুমে।

শুক্রবার ভোরবেলা উঠেই দিলাম ছুট। কারণ সকাল দশটার পর প্রবেশ নিষিদ্ধ। গাড়ি রেখে আবার দশ-পনেরো মিনিট বনবাদাড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। তবে ঝরনা দর্শনের পর সকল ঝক্কি ঝামেলাই অতীব তুচ্ছ মনে হবে। মনে হবে যেন বাস্তব স্বর্গে এসে পৌঁছেছেন।

এ বছর খারিফও দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়েছে। প্রকৃতিও যেন অন্যান্য সময়ের চেয়ে আরও বেশি সৌন্দর্য্যের পসরা নিয়ে হাজির হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসেও চলছে ঝরনার ছুটে চলা। প্রকৃতিকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে পৃথিবীতে করোনাভাইরাস নামক মহামারি চলছে। মনে মনে সবাই ভ্যাক্সিনের প্রতিক্ষায় আছে। তবে প্রবাসীদের প্রার্থনার পাল্লাটা একটু বেশি। আত্মার আত্মীয়দের দূরে রেখে কেউ কি আর শান্তিতে থাকতে পারে?

গত ছয় মাসে অনেকের বাবা-মা, নিকট আত্মীয়স্বজন মারা গেছেন। অথচ শেষবারের মতো দেখার সৌভাগ্যও পাননি কোনও কোনও প্রবাসী। আবার করোনাভাইরাসে আক্রান্তে মৃত কোন প্রবাসীকে পাঠানো হয়নি স্বদেশে। এটা যে কতটা কষ্টকর ও দুর্ভাগ্যজনক একমাত্র ভুক্তভোগী ও তার পরিবারই জানেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই সবসময় আমি একটা প্রার্থনা করি, প্রবাসে যেন কোনও প্রবাসীর মৃত্যু না হয়। এই প্রার্থনার পিছনের গল্পটি লিখবো আরেকদিন।

লেখক: ম্যানেজিং ডিরেক্টর, প্রাণ ফুডস, ওমান (সালালা)

ছবি: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!