'মিসকিন' অন্যখানে, সম্মান ওমানে

প্রবাস জীবন আমার দু’বছরের। কাজের প্রয়োজনে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। তবে মূলত ওমানেই থাকি।  

মোহাম্মদ ফারুক হোসেন, ওমানের মাস্কাট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2016, 11:53 AM
Updated : 19 Sept 2016, 01:58 PM

অন্যান্য আরবীয়দের সাথে ওমানের অধিবাসীদের রয়েছে বিস্তর ফারাক। অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি ওমানিদের প্রাচীন ইতিহাসও এই ফারাকের কারণ।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ধর্ম সবসময়ই বিশাল ভূমিকা রাখে। ওমানও ব্যতিক্রম নয়।

ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের একটি ক্ষুদ্রভাগ খারিজি মতবাদের অনুসারী। খারিজিদেরই একটি ভাগ হচ্ছে ইবাদি। যারা অন্যান্যদেশে সংখ্যালঘু হলেও ওমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

মূলত খলিফা নির্বাচনে কুরাইশ গোত্রের প্রাধান্য ও আরব-অনারবের মধ্যে পার্থক্যের বিরোধিতার কারণেই, খারিজিদের জন্ম। পরবর্তিতে আরবীয় সুন্নিদের থেকে নিজেদের রক্ষা করতেই তারা বিভিন্ন পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় নেয়। আর সে কারণেই অন্যান্য আরবীয়দের থেকে তাদের রয়েছে ভিন্নতা।

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দুবাই বা সৌদির অধিবাসীরা বাংলাদেশিদের দেখে ‘মিসকিন’ হিসেবে। তাদের চাহনিতে থাকে ‘করুণা’, ‘ঘৃণা’ অথবা ‘অবজ্ঞা’। সে তুলনায় বাংলাদেশিদের প্রতি ওমানিদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। ওরা আমাদের হয় ‘বন্ধু’ নচেৎ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে দেখে।

ওমানের আরব সাগর তীরের একটি পর্যটন কেন্দ্র

ওমানের আরব সাগর তীরের একটি পর্যটন কেন্দ্র

‘টাইমস অফ ওমান’ যখন শিরোনাম দেয় ‘প্রবাসীদের কারণে ওমানিদের আয় কমে যাচ্ছে’, তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ পেতে দেরি হয় না।

আবার যখন কিছু ওমানি বন্ধু ওদের রীতি অনুযায়ী আমার নাকে-গালে মুখ লাগিয়ে অভিবাদন জানায় তখন বন্ধুত্বের গন্ধটাও ধরা পড়ে সহজেই। অন্যকোন আরবীয়দের কাছ থেকে এরকম অভিবাদন- আমি আমার দু’বছরের প্রবাস জীবনে পাইনি।

ওমানে প্রবাসীদের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের জনসংখ্যাই বেশি। এর পরের অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানিরা।  এখানে রাস্তার ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডাক্তারির পদগুলো ভারতীয়দের দখলে। ভারতের কেরালা রাজ্যের লোকেরা ওমানের গুরুত্বপূর্ণ পদ্গুলো দখল করে আছে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও আছে তাদের ব্যাপক দাপট। সে তুলনায় তামিল লোকগুলো ভাল অবস্থানে নেই।

আর বাংলাদেশিদের মাঝে হোটেল-রেস্তোরাঁ,  মুদির দোকান ও নির্মাণ শিল্পে জড়িত লোকদের সংখ্যাই বেশি। সফল ব্যবসায়ীর সংখ্যাও কম নয়। যদিও ভারতীয়দের তুলনায় তা নিতান্তই নগণ্য।

রাজধানী মাস্কাটে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে চট্রগ্রামবাসী। এমনকি ওমানিরা পর্যন্ত বাংলাদেশ বলতে চট্রগ্রামকেই বোঝে।

আপনার জন্মস্থান চট্টগ্রাম বাদে বাংলাদেশের অন্য যে কোন জায়গায়  হলে এবং তা মাস্কাটের ওমানিদের বললে ওরা নির্দ্বিধায় বলবে- ‘তোমার বাড়ি তো বাংলাদেশ না!’ প্রথম প্রথম আমি হোঁচট খেয়েছি। এখন ওদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে শিখেছি।

তবে ওমানের দক্ষিণ প্রদেশীয় ‘সালালা’য় আবার সিলেটের লোকের সংখ্যা বেশি। ‘সালালা’ আগে ইয়েমেনের অংশ ছিল।  

পাকিস্তানিদের মাঝে ওমানে পাঠানের সংখ্যা বেশি। এরা গায়ে বাস্তবিক অর্থেই প্রচণ্ড শক্তি রাখে। তাই মাল টানাটানির কাজ, বড় গাড়ি ড্রাইভিং ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় পাকিস্তানিদের বেশি নজরে পরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারত-পাকিস্তানের মাঝে যে মারমার-কাটকাট ভাব আছে, সেটা ওমান প্রবাসীদের মাঝে খুব একটা চোখে পরে না। এখানে ভারতীয়-পাকিস্তানিদের মাঝে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই চোখে পড়ে। একই কথা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

পাকিস্তানিদের কথা বলতে গেলেই- একটা ঘটনা মনে পরে। মাস্কাটের কুরিয়াত এলাকার মাজারা ড্যামে পরিবার নিয়ে ঘুরতে গিয়েছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। আমার মতো অনেকেই এখানে পরিবার নিয়েই বেড়াতে আসে।

তবে বাংলাদেশি খুব একটা চোখে পরে না। ইউরোপিয়ান, ভারতীয় আর আরবীয়রাই বেশি ঘুরতে আসে।  

ওমানের আরব সাগর তীরের একটি পর্যটন কেন্দ্র

মাস্কাটের কুরিয়াত এলাকার মাজারা ড্যাম

আমি ঘুরছি আর আমার ছোট মেয়ের সাথে কথা বলে যাচ্ছি। হঠাৎ পাকিস্তানি ফ্যামিলি থেকে এক বৃদ্ধ এগিয়ে এসে আমাকে বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন-  ‘আপনার বাড়ি কি বাংলাদেশ?' আমি 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়লাম।

ওই বৃদ্ধ তার ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি ও স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন বুঝতে পারছি। সবারই গায়ে পাকিস্তানি আলখাল্লা। তাই বাংলা শুনে কিছুটা অবাক হলাম।

বৃদ্ধ আমার ডান হাত তার দু’হাতে মুঠোবন্দি করে ধরেছে। আমি বোকা বোকা হাসি মুখে ধরে রেখেছি। বৃদ্ধলোকটি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন, “আমার বাড়িও বাংলাদেশ। ফরিদপুর জেলায়। কতবছর বাপ-মায়ের ভিটা দেখি না! ”

‘কেন, দেশ ছাড়লেন কেন’- জানতে চাইলে তিনি পুরোপুরি কেঁদে দিলেন। তাঁর কান্না জড়ানো সব কথা বুঝতে পারিনি। যতটুকু বুঝলাম তা হল- তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল ফরিদপুর। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চাকুরি করতেন। বিয়েও হয়েছিল সেখানে। যুদ্ধের পর ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীর জন্য তিনি নিজের দেশকে ত্যাগ করেন। এখন সপরিবারে পাকিস্তানে থাকেন। ছেলে ওমানে চাকুরি করে। ছেলেই তাদের ভিজিট ভিসায় ওমানে এনেছেন।

নিজ দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে স্বেচ্ছায় ওই বৃদ্ধের বসবাসের গল্প যদি অন্য কারও মুখে শুনতাম তা হলে হয়তো রাগ ও ঘৃণার প্রতিক্রিয়া থাকতো। এই সুদূঢ় প্রবাসে- নিজেই ঘটনার সাক্ষ্য, তখন বৃদ্ধ লোকটার কষ্ট আমার ভেতরেও বাজতে লাগলো। দেশ থেকে দূরে থাকার হাহাকারে আমার চোখও ভারি হতে শুরু করল।

প্রবাসীরা এমনিতেই মানসিকভাবে দুর্বল হয়। হুটহাট করে বিনা নোটিশেই এদের চোখে জল আসে। আমার ছোট মেয়েকে জড়িয়ে ধরে যখন কোন প্রবাসী চোখের জল ফেলে, বুঝতে অসুবিধা হয় না আদরটা সে আমার মেয়েকে নয় বরং নিজের সন্তানকেই করছে। এখানে আমার মেয়ে রূপক। আবার কারো মা-কে দেখলে, নিজের মা বলেই মনে হয়।

এই তো কিছুদিন আগে আমার এক সহকর্মীর মা বেড়াতে আসলেন। আমার স্ত্রী বিভিন্ন ছুঁতায় তাকে এক নজর দেখতে যায়- এ জিনিসগুলো আমার নজর এড়ায় না। আমার ভিতরেও যে একই হাহাকার।  সহকর্মীর মা যেদিন বিদায় নিলেন, সেদিন আমার স্ত্রীর কি কান্না!

ওমানে কাজ করতে হলে আরবি আপনাকে শিখতেই হবে। ওমানিরা ইংরেজি তেমন বোঝে না। তবে শহুরে ওমানিরা বেশ হিন্দি বলতে পারে। বলিউড সিনেমার প্রভাব ওমানে লক্ষণীয়। প্রতিটা সিনেমা হলেই দেদারসে চলছে হিন্দি ফিল্ম। উঠতি ওমানিদের ভিড়ে সিনেমার টিকেট পাওয়া মুশকিল।

ওমানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বুনো। আরব আমিরাতের দুবাইয়ের মতো কৃত্রিম নয়। তবে পর্যটকরা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খোঁজে আসেন না। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য দুবাই শহরে রয়েছে হরেক রকমের নাইট ক্লাব। ওমানে যা পুরোপুরি নিষিদ্ধ।

মধ্যপ্রাচ্য বললেই মাথায় সবার আগে আসে, মরুভূমি-উট-প্রচণ্ড গরম। জুলাই মাসে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে থাকে জান খারাপ করা গরম। অথচ ওমানের সালালা অংশে থাকে ‘খারিফ সিজন’ বা বৃষ্টি মৌসুম । সারাদিন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি আর কুয়াশা। এসি কিংবা ফ্যান কোনটার প্রয়োজন নেই। মধ্যপ্রাচ্যের ধনবানরা তখন সালালায় বেড়াতে আসেন।

ইউরোপিয়ানদেরও থাকে উপচে পড়া ভিড়। হোটেল ভাড়া প্রায় তিনগুন হয়ে যায়। এমনকি ওমানিরা নিজেদের বাসা ছেড়ে পর্যটকদের ভাড়া দিয়ে দেয়। এ সময়েই পর্যটকদের থেকে সর্বোচ্চ আয় করে ওমান। সমগ্র সালালা হয়ে যায় সবুজ-শ্যামল। অথচ ওমানের অন্য প্রান্ত, মাস্কাটে থাকে ভয়াবহ গরম।

পরিবারের সঙ্গে লেখক সাগরতীরে

আমি অনেককেই প্রশ্ন করেছি দেশে ফিরে গেলে- ওমানের কী 'মিস' করবেন? সবচেয়ে বেশি ভোট পরেছে ‘জ্যাম ও হর্নবিহীন’ রাস্তার পক্ষে।

তবে আমি মিস করবো এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। প্রবাসীদের কেউ কেউ আবার ওমানের পাহাড়-পর্বতের প্রেমে পড়েন। আর আমি পরেছি আরব সাগরের প্রেমে। দেশে ফিরে গেলে আমি আরব সাগরটাকে ‘মিস’ করবো। এ সাগরকে ঘিরেই একসময় মিশরীয় ও আলেক্সান্দ্রিয়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ছোটবেলার নায়ক সিন্দাবাদের ছিল অবাধ বিচরণ।

সপ্তাহে অন্তত একটা দিন আমাকে সাগরে  হাজিরা দিতেই হবে। ওই বিশালতায় গিয়ে যখন পা ভিজিয়ে দাঁড়াই, তখন আমার সব ক্লান্তি-ক্ষুদ্রতা-তুচ্ছতা দূর হয়ে যায়।

শেষ করছি এক বাংলাদেশি প্রবাসীর কথা দিয়ে। দু'বছর হল এদেশে এসেছে। তার একমাত্র ছেলের বয়স চারবছর। অর্থাৎ দেশত্যাগের সময় ছেলের বয়স ছিল দু'বছর। প্রশ্নোচ্ছলে জিজ্ঞেস করলাম, "ছেলের সাথে তোএখন ফোনে কথা হয়, তাই না?"

প্রবাসী বন্ধুর কন্ঠ কেমন ভারী হয়ে গেল। বলল, “না, কথা হয়না। ছেলে কথা বলতে লজ্জা পায়। আমাকে সেভাবে চেনেনা।" শেষের লাইন বলতে গিয়ে দেখলাম ওর চোখের কোনে জমা হচ্ছে পানি। আমি আর কথা বাড়াতে পারলাম না।

প্রবাসী বন্ধুর গল্প দিয়ে শেষ করার কারণ একটাই। প্রবাসের যত হাসি-খুশি চেহারাই দেখুন না কেন, ধরে নিবেন তার ভিতরে নিরন্তর খেলা করে এক অগাধ 'শূন্যতা'। যা দিয়েই প্রবাসীরা আত্মীয়-স্বজনের বুকে 'পূর্ণতা’ আনার শ্রমে লিপ্ত।

লেখক:  হেড অফ মার্কেটিং (ওমান ও আরব আমিরাত), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ