ইয়াসমিনের আর্তনাদে মন গলেনি সৌদি নিয়োগকর্তার

দীর্ঘ আড়াই বছর দেশে কথা বলতে দেয়নি, কথা বলতে চাইলে বৈদ্যুতিক শক দিতো। বেতন চাইলে গরম ইস্ত্রিরি দিয়ে ছ্যাঁকা দিতো, নিয়মিত খেতে দিতো না। সৌদি আরবের নিয়োগকর্তা এরকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতো বলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে অভিযোগ করেন বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মী ইয়াসমিন আক্তার।

শেখ লিয়াকত আহম্মেদ, সৌদি আরব প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2020, 07:29 AM
Updated : 21 Jan 2020, 07:30 AM

পরিবারের স্বচ্ছলতা ও সন্তানদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে জীবিকার তাগিদে নারী গৃহকর্মী হিসেবে প্রায় চার বছর আগে সৌদি আরবে আসেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার ইয়াসমিন আক্তার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে উঠে আসে প্রবাসে তার দীর্ঘ সংগ্রামের কথা।

ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর নারী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবের মালিকের বাসা (নিয়োগকর্তা) তাবুক শহরে আসি। মালিক আব্দুল হাদিস আল আমরি স্থানীয় প্রশাসনের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা। তার বাড়িতে যাওয়ার পরদিনই আমার সঙ্গে থাকা মোবাইলটি কেড়ে নেয় এবং শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ঠিক মতো খাওয়া দিতো না, কথায় কথায় গায়ে হাত তুলতো, দেশে পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কথা বলতে দিতো না। বরং আরও বেশি নির্যাতন করতো, বহুবার বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে।

“নির্যাতনে আমার বাম হাতটি ভেঙ্গে গেছে, ঠিক মতো চিকিৎসা পর্যন্ত করায়নি। ভয়ে শত নির্যাতন সহ্য করে কাজ করেছি আড়াই বছর। কিন্তু এই আড়াই বছর একটি বেতনও দেয়নি। বেতন চাইলে গরম ইস্ত্রিরি দিয়ে ছ্যাঁকা দিতো। এমনকি গলা কেটে মরুভূমির মধ্যে পুতে রাখারও হুমকি দিতো।

“আড়াই বছর দেশে কোন যোগাযোগ করতে না পারায় আমার পরিবার ভেবেছিল আমাকে তারা মেরে ফেলেছে। আমার মেয়েরা আমার সন্ধান চেয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সৌদি দূতাবাসে আবেদন করে।”

ইয়াসমিন বলেন, “এর ফলে দূতাবাস আমার মালিকের (নিয়োগকর্তা) সঙ্গে যোগাযোগ করলে মালিক ক্ষিপ্ত হয়ে আরও বেশি নির্যাতন করে। আমি নাকি তার মান-সম্মান খুঁইয়েছি। পরে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আমি বাসা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দার সেভ হোমে আশ্রয় নিই। সেখানে বেশ কিছুদিন ছিলাম। জেদ্দা থেকে থেকে রিয়াদ আসি। দূতাবাসের স্যাররা আমাকে সব সহায়তা করেছেন। সাড়ে তিন বছরের সব বেতন আদালতের মাধ্যমে স্যাররা আদায় করে দিয়েছেন। আমি এখন দেশে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি।”

দূতাবাসের শ্রমকল্যাণ উইং মেহেদী হাসান

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দূতাবাসের শ্রমকল্যাণ উইং মেহেদী হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গৃহকর্মী ইয়াসমিন নিয়োগকর্তার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাসা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দায় সেভ হোমে আশ্রয় নেয়। জেদ্দা কনস্যুলেট অফিস তার মালিকের সঙ্গে অনেকবার চেষ্টা করেও তেমন কোন সমাধানে আসতে পারেনি।

“পরে ওই মালিক রিয়াদে বদলি হওয়ায় আমারা ইয়াসমিনের সব পাওনা আদায়ে স্থানীয় শ্রম আদালতে মামলা করি। চারটি শুনানির পর শ্রম আদালত ভিকটিম ইয়াসমিনের পক্ষে রায় দেয়। ইয়াসমিনের বকেয়া ৪২ মাসের বেতন ৪২ হাজার সৌদি রিয়েল, প্রায় ৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এ টাকা আদায় করে ইয়াসমিনকে বুঝিয়ে দেই এবং খুব শিঘ্রই সে দেশে চলে যাবে।”

মেহেদী হাসান জানান, ইয়াসমিনের নিয়োগকর্তা সৌদি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় মামলায় জিততে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। যথাযথ ডকুমেন্ট থাকলে নিয়োগকর্তা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন প্রতিটি শ্রমিক ও নারী গৃহকর্মীদের সব বেতন ভাতা আদায়ে দূতাবাস কাজ করতে পারে।

প্রবাসীরা জানান, ২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে এক চুক্তির পর বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী পাঠানো শুরু হয় সৌদি আরবে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই নারীদের শারীরিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগ আসতে থাকে। সৌদি নিয়োগকর্তা কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে নারী গৃহকর্মীরা দূতাবাসের আসতে থাকে। দূতাবাস তাদের আশ্রয় দিতে রিয়াদ ও জেদ্দায় দুটি ‘সেভ হোম’ (নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র) খোলে। আশ্রিত নারী গৃহকর্মীদের থাকা খাওয়া, চিকিৎসা ও তাদের বকেয়া বেতন আদায়ে আইনি সহায়তায় কাজ করছে দূতাবাস।

ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “কোন নারী গৃহকর্মী যেন সৌদি আরবে এসে আমার মতো নির্যাতনের শিকার না হয়। নারী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে আসার আগে তারা যেন ভেবেচিন্তে কাজ করেন।”

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!