ক্যারিবিয় স্বর্গ ভার্জিন আইল্যান্ডস, শেষ পর্ব

প্রাতঃরাশ সেরে সকাল সকাল চলে গেলাম কোরাল ওয়ার্ল্ড ওশান পার্কে। এটা একটা মেরিন পার্ক তথা আন্ডার সি অবসার্ভেটরি। স্নোর্কেলিংয়ের সাধ কিছুটা হলেও মিটলো এখানে এসে। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো আর কি!

সোফিয়া নিশি, যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Sept 2019, 10:04 AM
Updated : 10 Sept 2019, 10:04 AM

বিভিন্নরকম  সামুদ্রিক প্রাণী দেখার সুযোগ মেলে এখানে। আর আট দশটা মেরিন পার্কের মতোই। বিশেষ কিছু নয়। বিশেষত্ব যেটা সেটা হলো, এখানে বিশেষ হেলমেট পরে আর অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে সরাসরি সমুদ্রের তলদেশে নেমে হাঁটার ব্যবস্থা আছে যাকে ‘সি ট্রেকিং’ বলে। সাথে স্নুবা ডাইভিং এরও ব্যবস্থা আছে।

আমরা ঐসব অভিজ্ঞতা আর নিলাম না। আমীরা সাথে আছে। আর ভীতু সে তো আগেই বলেছি। আমীরা তো বাহানা মাত্র। পরে বন্ধুতালিকায় থাকা অনেককেই দেখেছি বালিতে গিয়ে সি ট্রেকিং করতে। তখন মনে হয়েছে, ইশ! আমিও তো করতে পারতাম!

এখানে একটা ‘সেমি সাবমেরিন রাইড’ আছে আধাঘণ্টার। সেমি সাবমেরিনে চড়ার ইচ্ছা ছিল। ওটা আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য সমুদ্র তলদেশ থেকে ঘুরিয়ে আনবে। আমার মতো ভীতুর ডিমের জন্য একদম পারফেক্ট ছিল। আমীরাকেও নেয়া যেত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ঐদিন কোন কারণে সেমি সাবমেরিন রাইড বন্ধ ছিল। তাই ঘুরে ফিরে আন্ডার সি অবজার্ভেটরি টাওয়ারই ছিল ভরসা।

উপকূল থেকে প্রায় ১০০ ফুট দূরে সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এই ত্রিতলবিশিষ্ট অবজার্ভেটরি টাওয়ার যার সর্বনিম্ন লেভেল সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১৫-২০ ফুট গভীরে। ক্যারিবিয়ানের একমাত্র আন্ডার সি অবজার্ভেটরি টাওয়ার এটা। গভীরতা তেমন বেশি না হলেও খুব মনোরম লোকেশনে এই টাওয়ারের অবস্থান। নানা বর্ণের অসংখ্য প্রবাল, সামুদ্রিক প্রাণী আর উদ্ভিদের এক অনন্য জগৎ! মনে হলো বুঝি এক বিশাল অ্যাকুরিয়াম।

সমুদ্রের তলদেশ ডিসকভারি আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে তো কতবার দেখেছি। আটলান্টাতে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় অ্যাকুরিয়াম আছে। ওখানেও গিয়েছি। কিন্তু সত্যি সত্যি সমুদ্রের তলদেশ এই প্রথম দেখছি। যদিও কাচের অপর পাশ থেকে দেখছি। সমুদ্রের তলদেশে যে আরেকটা জগৎ বিচরণ করে, আর কত যে বিচিত্র ও বর্ণিল হতে পারে সেই জগৎ, তার ছোট্ট একটা নমুনা দেখলাম মাত্র। কয়েকজন স্নুবা ডাইভারকেও দেখলাম। সি ট্রেকিং করছে এমন কিছু মানুষকেও দেখলাম। আমাদেরকে হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানালো তারা। আমীরাও অনেক উপভোগ করলো ওখানে। সর্বোপরি এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো।

সামুদ্রিক প্রাণী আর প্রবাল দর্শন শেষ হওয়ার পর গেলাম কাছের ছোট্ট দ্বীপ ওয়াটার আইল্যান্ডে। ওখানে যাওয়ার আগে একটা ডক সাইড রেস্টুরেন্ট কাম বারে বসে আমাদের লাঞ্চ সেরে নিলাম। বেশিরভাগ আইটেম আমাদের জন্য অনুপযুক্ত। সালসা দিয়ে চিপস আর সালাদ নিলাম। মেক্সিকান খাবার এটা। লাঞ্চ না বলে স্ন্যাক্স বলাই বোধহয় উচিত। আমীরার জন্য যথারীতি নিজের হাতে বানানো খিচুড়ি। বাই দ্য ওয়ে, প্রতিদিন ঘোরাফেরা শেষে রিসোর্টে গিয়েই আমি কিচেনে ঢুকতাম টুকটাক এটা সেটা বানানোর জন্য। বিশেষ করে আমার দেড় বছর বয়সী মেয়েটার জন্য। কখনো খিচুড়ি, কখনো পাস্তা করতাম। বেচারিকে বেশি কষ্ট দিতে চাইনি খাওয়ার। নিজে শত কষ্ট সহ্য করতে রাজি আছি।

ওয়াটার আইল্যান্ডের ডকে ভেড়ার পর ডক থেকে সৈকতে আসা যাওয়ার জন্য একটা শাটল সার্ভিস আছে স্থানীয় এক রেস্টুরেন্টের সৌজন্যে। শাটল চালকের সাথে কথা হলো। সে জানালো, ট্যুরিস্ট ছাড়া এই দ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র নব্বই জন। দেখার মতো আছে সৈকত ছাড়া একটা ফোর্ট যেটা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। গাড়ি যায় না ওখানে। হাইক করা সেখানে যাওয়ার একমাত্র উপায়। বাচ্চা নিয়ে পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠা সম্ভব মনে হলো না। আবার স্ট্রলারও নেয়ার উপযোগী হাইক না সেটি। তাই ছোট্ট এক চিলতে সৈকতই ছিল আমাদের ভরসা। হানিমুন বিচ নামের ছোট্ট সৈকতটায় আমাদের সকালের দ্বিতীয়ার্ধটা কাটলো অনেক আয়েশি ভঙ্গিতে। আমীরাও এই ক'দিনের মধ্যে আজই প্রথম সুযোগ পেলো বাইরে একটু দৌঁড়াদৌঁড়ি করার। নইলে আমাদের স্যুটের ভিতর ছাড়া তেমন একটা ছাড়া হয়নি কোথাও।

দুপুরের পর রিসোর্টে ফিরে আসলাম। ফিরে যাওয়ার সময় আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী জানতে পেরে, আর ডিনারের পরিকল্পনা শুনে সেই চালকই সাজেস্ট করলো সেইন্ট থমাসের খুব জনপ্রিয়, আর হাইলি রেটেড একটা ক্যারিবিয়ান ফিউশন কুইজিন রেস্টুরেন্ট। আমিও গুগলে স্টাডি করে দেখলাম, বেশ হাইলি রিকমেন্ডেড ওই রেস্টুরেন্ট।

আজকের দিনে খুব একটা প্ল্যান রাখিনি। বিকেল হওয়ার পরপরই অ্যানিভার্সারি ডিনার করতে চলে গেলাম সেই রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টটা আবার একটা বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতর। দু’দিন আগে যে পাহাড়ি বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়েছিলাম, তার চেয়ে এটা বেশি সুন্দর, আর গোছানো। ডিনার করতে এসে এটা ছিল বাড়তি পাওনা। কিছু জলজ উদ্ভিদের বাগানও ছিল সেখানে। ছোট একটা কৃত্রিম পদ্মপুকুর দেখে খুব ভালো লাগলো। সেখান থেকে আইডিয়া পেলাম এরকম একটা পদ্ম পুকুর বাসাতেই বানানোর।

আমি কিন্তু ফিরে এসে পরে সত্যিই একটা মিনিয়েচার সাইজ পদ্মপুকুর বানিয়েছি বাসায় বড় সাইজের টবে। এভাবে ঘুরতে গিয়ে পাওয়া ছোট ছোট সুন্দর আইডিয়াগুলো খুব কাজে আসে আমার। আমার বাসার প্রধান আকর্ষণগুলোর একটা এখন আমার এই মিনি পদ্মপুকুর। আমি খুব খুশি হয়েই সবাইকে বলি কোত্থেকে পেয়েছি আমি এই অদ্ভুত সুন্দর আইডিয়া। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, এবার একটা সত্যিকারের মিনি পুকুর বানাবো আমার ব্যাক ইয়ার্ডে। সেখানেও পদ্ম থাকবে, ছোট বাঁশঝাড় থাকবে, অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ থাকবে, আর থাকবে রংবেরঙের গোল্ড কিংবা কই ফিশ।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসলাম জানালার পাশে। ওখান থেকে সেই বিখ্যাত মেগান্স বে সৈকত দেখা যায় প্রায় বারশ ফুট উপর থেকে। এটাও একটা কারণ এই রেস্টুরেন্টের এতো হাই রেটিং এর। ডিনারে অর্ডার করলাম স্যামন ফিশ ফিলে আর ক্র্যাব কেকের একটা প্ল্যাটার। অর্ডার রেডি হতে হতে রেস্টুরেন্টের লাগোয়া ব্যালকনিতে চলে এলাম। মন ভরে একবার শেষবারের মতো দেখে নিলাম চারপাশের মনোরম দৃশ্য, অপূর্ব সুন্দর মেগান্স বে সৈকত। এর মাঝেই আমাদের খাবার চলে এলো। চারপাশের দৃশ্য দেখে যতটা বিমোহিত হয়েছিলাম, ঠিক ততটাই হতাশ হয়েছি খাবারের উপর। বিশ্বাস করুন, এতো জঘন্য স্বাদের স্যামন আর কখনোই খাইনি আমরা।

ঘুরতে গেলে এমনিতেই আমার মুখে খাবার রুচে না। তাই নিজেই প্রায় এটা সেটা বানিয়ে খাই। তার উপর খুব শখ করে হাই রেটিং আর রিকমেন্ডেশন দেখে এখানে আসা। খুব হতাশ হয়েছিলাম। পাভেলো আবার ভালো খারাপ সব খাবারই কেমনে জানি গিলতে পারে। আমার রান্না খেয়ে খেয়ে এই অভ্যাস হয়েছে হয়তো! সন্দিহান হয়ে গেলাম, আমার রান্না কি তবে খুব বেশি অখাদ্য হয়?! যাই হোক, সে মোটামুটি খেলো। আমি রিসোর্টে ফিরে এসে আগের বানিয়ে রাখা পাস্তা দিয়ে উদরপূর্তি করলাম।

পরদিন ঘুম থেকে উঠেই ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি। দুপুরের পর আমাদের ফ্লাইট। তাই বেলা করে উঠলাম। চেক আউট করে রিসোর্ট প্রাঙ্গন শেষবারের মতো একটু ঘুরেফিরে দেখে চলে গেলাম এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এক সৈকতে। লিন্ডবার্গ বিচ। উদ্দেশ্য ফিরে যাওয়ার আগে আরেকবার শেষবারের মতো বিচ সাইড বারে বসে সমুদ্র দর্শন আর সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়ানো।

আটলান্টার খুব কাছাকাছি কোন সৈকত নেই। সবচেয়ে কাছের সৈকতটিও চার ঘণ্টার বেশি ড্রাইভিং দূরত্বে অবস্থিত। চট্টগ্রামে সাগর পাড়ে বেড়ে ওঠা আমি এই একটা অভাব ভীষণভাবে অনুভব করি ওখানে। সৈকত দেখার সাথে সাথে ট্রপিক্যাল ফ্রুটসের তাজা রসে গলাও ভিজানো হলো। ওখানে বসে বসে ট্যুরিস্টদের নানা রকম ওয়াটার স্পোর্টসও দেখা হলো। আমি যদিও কখনোই এসব স্পোর্টস ট্রাই করিনি, কিন্তু অন্যদের উত্তেজনা আর উপভোগ দেখতে ভালোই লাগে।

সময় শেষ হয়ে আসছে টিকটিক করে। গাড়ি ফেরত দিয়ে এয়ারপোর্ট শাটলে চড়ে বসলাম ব্যাগ ব্যাগেজ সমেত। সেই সাথে শেষ হলো আমাদের ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ডস ভ্যাকেশন। কিন্তু শেষ হয়েও দেখা শেষ হলোনা ভার্জিন আইল্যান্ডস। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মতোই রেশ রয়ে গেলো তার। বরং এখানে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রবল হলো কেবল।

লেখক পরিচিতি: বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়  থেকে এসএসসি, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি, এরপর চট্টগ্ৰাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস। ৩৩তম বিসিএসে কৃতকার্য হয়ে পদায়ন হয়েছিল আমার গ্রামে, সন্দ্বীপ উপজেলায়। বছর দুয়েক চাকরি করি। এরপর পরিবারসহ স্থায়ীভাবে দেশান্তরী হই। বর্তমানে বসবাস করছি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল লাইসেন্স পেতে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। ঘুরে বেড়াতে ভীষণ পছন্দ করি। এই পর্যন্ত ভ্রমণ করেছি যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ২২টি অঙ্গরাজ্যে। আর এর বাইরে ৬টি দেশ ভ্রমণ করা হয়েছে।

আগের পর্ব

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!