ক্যারিবিয় স্বর্গ ভার্জিন আইল্যান্ডস, পর্ব ৩

খোলা সাগরের মধ্য দিয়ে ফেরিযাত্রা শুরু হলো। গাড়ি থেকে নেমে ফেরির রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে সাগরপাড়ের দৃশ্য দেখতে এলাম। নীল সমুদ্রের মধ্য দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছে আমাদের ফেরি।

সোফিয়া নিশি, যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2019, 05:54 AM
Updated : 31 August 2019, 05:55 AM

আমাদের ফেরি ছাড়াও আশপাশে ছোট ও মাঝারি সাইজের অনেক বোট আছে। কিছু ফিশিং বোট, কিছু স্নরকেলিং বোট। প্রাইভেট বোট চার্টার করেও পয়সাওয়ালারা এখানে ঘোরাঘুরি করে। কি যে উপভোগ্য তাদের জীবন! তাড়িয়ে তাড়িয়ে জীবনকে উপভোগে এদের কোন জুড়ি নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল ফেরিযাত্রা। ভিড়লো এসে সেইন্ট জন দ্বীপের ক্রুজ বে তে।

ফেরি থেকে নেমে আবার গাড়িতে যাত্রা করলাম। একদিনে এই দ্বীপের যতটা দেখা যায় দেখে নিতে হবে। ডক থেকে বের হওয়ার সময় একটা ম্যাপ সংগ্রহ করে নিলাম এই দ্বীপের। ক্রুজ বে ডক থেকে বের হয়ে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠেই অবাক হয়ে গেলাম। এ কোথায় চলে এসেছি আমরা! মর্ত্যলোকে এতো সুন্দর দ্বীপ! ক্যারিবিয় সাগরের বুকে ছোট্ট এক টুকরা স্বর্গ যেন এই সেইন্ট জন। সেইন্ট থমাসের ঠিক পাশেই। অথচ রূপে গুণে কত পার্থক্য! সেইন্ট থমাস অনেকটুকুই শহরায়িত।

লেখকের স্বামী পাভেলো ও মেয়ে আমীরা

কিন্তু সেইন্ট জনে এখনো শহরায়নের ছোঁয়া লাগেনি তেমন। সীমিত সংখ্যক ব্যয়বহুল রিসোর্ট আছে এখানে। আর আছে অপরূপ সুন্দর সুনীল সব সমুদ্র সৈকত, সবুজ পাহাড় ও বনানি। এই দ্বীপের শতকরা আশিভাগই ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রাকৃতিক আবহ বজায় আছে পুরোপুরি। এই দ্বীপের দুইটা রং। সবুজ ও নীল। এক কথায় অনন্য। এই দ্বীপের রূপ সৌন্দর্য নিয়ে যাই বলিনা কেন আসলে কম হয়ে যাবে।

পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় অসাধারণ সুন্দর সব দৃশ্য! বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়া থেকে পাওয়া যায় সুন্দর সুন্দর সব নীল বিচ ভিউ। এখানকার সৈকতের ছবিগুলো দেখলে মনে হয় যেন, এডিট করে এমন নীল করা হয়েছে। আসলে মোটেও তা না। সমুদ্র সৈকতের পানি যে আসলেই এত চমৎকার নীল হতে পারে এখানে না আসলে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতোনা। ক্রুজ বে, ট্রাঙ্ক বে, সিনামন যে, ক্যানিল বে, মাহো বে, হকনেস্ট বিচ, লিন্সটার বে, কোরাল বে... কত যে সুন্দর সুন্দর নাম এর সৈকতগুলোর! ‘বে’ মানে হলো ছোট্ট সৈকত।

ড্রাইভ করে দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব শুধু দেখেছি। দু'তিনটি সৈকতে গিয়েছি। পশ্চিমাদের মতো সারাদিন একটা সৈকতে বসে আরামসে গা এলিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের এই একদিনেই যতটুকু সম্ভব দেখতে হবে। সন্ধ্যায় ফিরে যেতে হবে সেইন্ট থমাসে। এই দ্বীপে অনেক ট্রেইল আছে হাইকিং আর ট্রেকিং এর জন্য। আমীরাকে নিয়ে আমরা ওসব পথ আর মাড়াইনি। তাছাড়া প্রচণ্ড গরমও পড়েছে।

দ্বীপের অপর প্রান্ত কোরাল বে তে এসে আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা হলো। সমুদ্রের পাড়ে বসে ঠাণ্ডা লোনা বাতাসে সমুদ্র দেখতে দেখতে সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার মজাই আলাদা। কোরাল বে'র সাথেই লাগোয়া একটি রেস্টুরেন্টে বসে স্থানীয় সি-ফুড নিলাম  আমরা। ক্যারিবিয় স্টাইলে রান্না করা ফ্রেশ টুনা আর শ্রিম্পের আইটেম। আর মেয়েকে দিলাম নিজের রান্না করে নিয়ে আসা পাস্তা।

আমি যে খাদক হিসেবে খুব সি-ফুড লাভার, তা কিন্তু না। ওদের আধা কাঁচা সবজি খেতে আমার কখনোই ভালো লাগে না। আর হালাল না বলে কখনোই মিট নেই না। তাই সি-ফুডই আমার জন্য অপশন। কোরাল বে'তে ডক করা আছে অনেক নৌকা, স্পিড বোট, ফিশিং বোট। কেউ যাচ্ছে, কেউ ফিরে আসছে। তাদের নানা কার্যকলাপ দেখতে দেখতে ডক ভিউ রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চটা বেশ উপভোগ্যই হলো।

এরপর ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম ‘অ্যানাবারগ প্ল্যানেটেশন’ এর ধ্বংসাবশেষে। একটা কথা না বললেই নয়। সেইন্ট জনের উঁচু নিচু ভীষণ খাড়া রাস্তায় সেডান নিয়ে বেশ কষ্টই হয়েছিল আমাদের। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ নেই। নইলে এই দ্বীপের জন্য জিপ বা একটু হেভি ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি প্রয়োজন। পাভেলো বেশ ভালো ড্রাইভ করে বলে আমরা কোথাও আটকে যাইনি বা বিপদে পড়িনি। তবে ভয় পেয়েছি বেশ।

অ্যানাবারগ প্ল্যানেটেশনে এক ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট পরিবারের সঙ্গে কথা হলো। মধ্যবয়সী বাবা মা আর তাদের টিনেজার দুই ছেলে মেয়ে। ভদ্রলোক বেশ মিশুক। আমাদের সঙ্গে অনেক কথা বললেন। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেক কিছু জানা হলো। যুক্তরাষ্ট্র অন্তর্ভুক্তির আগে প্রায় আড়াইশো বছর ডেনমার্ক-নরওয়ে ভিত্তিক ডেনিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোম্পানির শাসনাধীন ছিল এই দ্বীপাঞ্চল। তারা এই দ্বীপাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছিল অনেক প্ল্যানেটেশন (বিভিন্ন পণ্য যেমন, কফি, তামাক, তুলা, চিনি ইত্যাদি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যে চাষাবাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এস্টেট)। আর চাষের কাজে নিয়োগ করা হতো মূলত আফ্ৰিকান আমেরিকানদের। মানে চাষের সঙ্গে সঙ্গে দাস ব্যবসারও কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই দ্বীপাঞ্চল।

এই দাস ব্যবসা আরো প্রসার লাভ করে যখন চাষবাস বন্ধ হয়ে তার পরিবর্তে এখানকার ফ্রি পোর্টকে কেন্দ্র করে বহুগুণ লাভজনক বিয়ারের বহুল উৎপাদন শুরু হয় এই দ্বীপে। বহু বছর ধরে বিয়ার উৎপাদনই ছিল এই দ্বীপাঞ্চলের প্রধান ব্যবসা। তখন একে বলা হতো ‘টাফাস’, মানে ‘ট্যাপ হাউজ’ যার অর্থ দাঁড়ায় ‘বিয়ার হাউজ’। এখনো অয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন স্পটে ফ্রি রাম, বিয়ার অফার করা হয়। তো যাই হোক, সেরকমই একটি প্ল্যানেটেশনের ধ্বংসাবশেষ এই অ্যানাবারগ প্ল্যানেটেশন। এরকম আরো কিছু প্ল্যানেটেশনের ধ্বংসাবশেষ আছে এখানে। সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে এটাই।

এদিকে প্রচণ্ড রৌদ্রের তাপদাহে ক্লান্ত হয়ে আমীরা ঘুমিয়ে পড়েছে তার বাবার বুকে, ক্যারিয়ার ব্যাগে ঝুলন্ত অবস্থাতেই। তাই আমরা এখানে কিছুক্ষণ বিরতি নিলাম। অনেক নয়নাভিরাম সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত এই অ্যানাবারগ প্ল্যানেটেশন এরিয়া। এর ঠিক সাথেই লাগোয়া নিচের সৈকতটা হলো লিনস্টার বে।

এখনকার সৈকতগুলোর আলাদা আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। লিনস্টার বে'র বৈশিষ্ট্য হলো, প্রায় মাইল খানেক দীর্ঘ লিনস্টার ট্রেইল যা অ্যানাবার্গ প্ল্যানেটেশন থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে এই পাথুরে সৈকতের পাশ দিয়ে ঘেঁষে মূল সড়কের সাথে মিশেছে। ট্রেইল দিয়ে হেঁটে আসতে পথে চোখে পড়বে বড় বড় পাথর ও বোল্ডার। ভাগ্য সহায় থাকলে দেখা মিলতেও পারে হরিণের।

এই পথ দিয়ে যেতেই চোখে পড়বে 'ওয়াটারমেলন কে', যেটা এই দ্বীপের অন্যতম বেস্ট স্নোর্কেলিং স্পট। এখানে দেখা মিলে বিপন্ন গ্রিন সি টার্টল, অক্টোপাস, শার্ক ছাড়াও নানা প্রজাতির রঙিন ছোট ছোট মাছ ও রঙবেরঙের প্রবাল যা আমাদের ঘরে অ্যাকুরিয়ামে শোভা পেয়ে থাকে। দুঃখের ব্যাপার, এগুলোর কিছুই দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের। কারণ আমরা স্নোর্কেলিংই করিনি। সাঁতার জানি না বলে আমার সাহস হয়নি। যদিও স্নোর্কেলিঙের জন্য সবসময় সাঁতার জানা আবশ্যক নয়।

অ্যানাবারগ প্ল্যানেটেশনের পর গেলাম সিনমোন বে তে। সিনামন বে প্রায় আধামাইল দীর্ঘ একটা সৈকত। আর এই নাতিদীর্ঘ সৈকতখানাই নাকি সেইন্ট জনের দীর্ঘতম সৈকত! আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দৈর্ঘ্য শুনলে এরা মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে। হা হা হা! সত্যি বলতে কি কক্সবাজার সৈকত সবার আগে দেখে ফেলেছি বলে এরপর যে কোন সৈকতকে আমার কাছে খুব ছোট লাগে।

সবশেষে গেলাম ট্রাঙ্ক বে তে। এই সেই সাদা বালির নীল সৈকত যেটা ড্রাইভ করতে করতে পাহাড়ের উপর থেকে ইতোমধ্যে কয়েকবার দেখে ফেলেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। পাহাড় বা ক্লিফের উপর থেকে অপূর্ব সুন্দর দেখায় এই সৈকত। সামনাসামনিও সৌন্দর্য কিছুমাত্র কম নয়। স্বচ্ছ পরিষ্কার নীল পানি আর ঝকমকে সাদা ছোট্ট বালুকাবেলা দুয়ে মিলে এক কথায় অনন্য। এখন পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র সৈকত এই ট্রাঙ্ক বে। আমি পছন্দ করি শান্ত কিংবা উত্তাল ঢেউয়ে হালকা পা ভিজিয়ে সমুদ্র সৈকতে হেঁটে বেড়াতে কিংবা শুধুই বসে বসে সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়াতে। পানিতে নামি না তেমন।

কিন্তু এই সৈকতের এতো স্বচ্ছ নীল পানি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। মেয়েকে কোলে নিয়ে নেমেই পড়লাম। তবে আমীরার কান্নাকাটির জন্য বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। মেয়েটা এখনো সমুদ্র ভয় পায়। সৈকত থেকে উঠে গোসল সেরে ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরে নিলাম। এরপর একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে চললাম সেইন্ট থমাস। আবার যদি কখনো আসার সুযোগ পাই এদিকে, নিঃসন্দেহে বেছে নিব সেইন্ট জন। অসম্ভব রোমান্টিক একটা দ্বীপ।

চলবে...

লেখক পরিচিতি: বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়  থেকে এসএসসি, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি, এরপর চট্টগ্ৰাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস। ৩৩তম বিসিএসে কৃতকার্য হয়ে পদায়ন হয়েছিল আমার গ্রামে, সন্দ্বীপ উপজেলায়। বছর দুয়েক চাকরি করি। এরপর পরিবারসহ স্থায়ীভাবে দেশান্তরী হই। বর্তমানে বসবাস করছি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল লাইসেন্স পেতে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। ঘুরে বেড়াতে ভীষণ পছন্দ করি। এই পর্যন্ত ভ্রমণ করেছি যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ২২টি অঙ্গরাজ্যে। আর এর বাইরে ৬টি দেশ ভ্রমণ করা হয়েছে।

আগের পর্ব

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!