উচ্চশিক্ষা নিতে সুদূর চীন যাওয়ার উপায়  

আমাদের সহজাত স্বপ্ন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার জীবন শেষ করে একটা মানসম্মত চাকরি খুঁজে নেওয়া।আমরা বেশিরভাগই চেষ্টা করি সরকারি চাকরি পাওয়ার, অন্যথায় বেসরকারি চাকরিই হয়ে যায় আমাদের জীবনে চলার পাথেয়।

মো. মাহবুবুর রহমান, চীন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2019, 08:47 AM
Updated : 4 Sept 2019, 08:47 AM

অনেকে আবার আরো বড় স্বপ্ন নিয়ে পথ খুঁজতে থাকেন উন্নত বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে। কেউ যায় পড়ালেখার মাধ্যম দিয়ে, আবার কেউ যায় সরাসরি ইমিগ্রান্ট হয়ে। যারা ইমিগ্রান্ট হয়ে উন্নত দেশে চলে যান, তাদের দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে না। আবার যারা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যান, তাদের মধ্যে অনেকেই এক দেশ থেকে ভাল সুযোগ তৈরি করে অন্য দেশে বা ওই দেশেই স্থায়ী হয়ে যান। অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রি শেষে ফিরে আসতে চান নিজ দেশে, মাতৃভূমিতে।

ইদানিং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে, আর সেই সাথে দেশ ছাড়ার প্রবণতাও উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে তরুণদের মাঝে। সেই ক্ষেত্রে সবার লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশোনা বা স্থায়ী হওয়া। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজি ভাষা দক্ষতা, অপ্রতুল গবেষণার অভিজ্ঞতা বা পর্যাপ্ত টাকার যোগান দিতে না পারা।

বেশির ভাগ তরুণের উন্নত জীবনের স্বপ্ন থমকে দাঁড়ায়, বিলিন হয়ে যায় অনেকভাবে, অনেক কষ্টকর প্রচেষ্টার পরও। অনেকেই আবার সঠিক তথ্য, সঠিক পথ, সঠিক দেশ বা ইউনিভার্সিটি নির্বাচন না করতে পেরে হেরে যায়। জলাঞ্জলি দিতে হয় অনেক টাকা-পয়সা, অনেক পরিশ্রম, জীবনের মহামূল্যবান সময় আর চোখের পানি।

আমার গত আট বছরে চারটা ভিন্ন ভিন্ন উন্নত দেশে- সুইডেন, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও চীনে পড়ালেখা করার অভিজ্ঞতা থেকে উচ্চশিক্ষার পাথওয়ে বিষয়ক একটা উপলদ্ধি এসেছে। উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষা মানে অনেকেই ধরে নেন, যাদের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট অনেক ভাল বা যাদের বাবার অনেক টাকা-পয়সা আছে, শুধু তাদের জন্যই ওই স্বপ্ন দেখা প্রযোজ্য, ওটা ব্রাহ্মণ শ্রেণিভুক্ত ব্যাপার। বাকিদের কাছে তা বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর নামান্তর।

আসলে কি তাই? বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুর্বল অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট নিয়েও অনেক বড় গবেষক বা উচ্চশিক্ষা অর্জন করা সম্ভব। এজন্য দরকার অদম্য ইচ্ছা, সঠিক দিকনির্দেশনা আর ভাল ইংরেজি ভাষা দক্ষতা। এই তিনের সমন্বয় ঘটিয়ে বেছে নিতে হবে যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষার পাথওয়ে। পাথওয়ে বলতে আমরা বুঝি যে যখন সরাসরি যেতে পারছি না বা সব শর্ত পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন একটা কার্যকরী বিকল্প মাধ্যম গ্রহণ করা।

অস্ট্রেলিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অথবা মাস্টার্স, এমনকি পিএইচডি প্রোগ্রামগুলোতে এই ধরণের পাথওয়ে সিস্টেম চালু আছে। যার মাধ্যমে সহজেই নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা করার সুযোগ পাওয়া যায়। আবার অনেকেই অন্য দেশ থেকে ব্যাচেলর বা মাস্টার্স ডিগ্রি করে খুব সহজেই সরাসরি উন্নত বা কাঙ্খিত দেশে মাস্টার্স বা পিএইচডি স্কলারশিপ পেয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ব্যাচেলর অথবা মাস্টার্স দেশ থেকে করা থাকে, তাহলে কেন আরেক দেশ থেকে আবার করতে হবে? আসলে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে সব শর্ত, তা আমাদের দেশের ব্যাচেলর অথবা মাস্টার্স  ডিগ্রির দ্বারা পূরণ হয় না। তাই অন্য কোনো মধ্যম মানের দেশকে বেছে নিতে হবে, যাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাল মানের গবেষণা হয়। আর সেই সাথে পড়ালেখা আর থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ স্কলারশিপও পাওয়া যায়।

এক্ষেত্রে সুবিধা হলো ভাল মানের গবেষণার হাতেখড়ি হবে, গবেষণাপত্র কিভাবে লিখতে হয় বা প্রকাশ করতে হয় তা জানা যাবে, উচ্চতর গবেষণার আগ্রহ তৈরি হবে, টাকা-পয়সা পাওয়া যাবে আর সেই সাথে একটা ভাল দেশে, উন্নত পরিবেশে থাকা বা ঘোরাঘুরি করার সুযোগ তৈরি হবে। সর্বোপরি, কাঙ্খিত দেশে বা ইউনিভার্সিটিতে সহজেই ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পথ সুগম হবে।

আমার জানামতে, গত ৫/৬ বছরে শত শত ছেলে-মেয়ে মালয়েশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া বা থাইল্যান্ডকে পাথওয়ে হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনেক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকরা স্কলারশিপ নিয়ে সফলতার সঙ্গে পড়াশোনা করে যাচ্ছে, দিয়ে যাচ্ছে দক্ষতার পরিচয়। এখন পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলের অধিকাংশ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলাদেশি অধ্যাপক, গবেষক বা স্বনামধন্য ছাত্র-ছাত্রী হরহমেশাই দেখা যায়।

গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মালয়েশিয়াকে পাথওয়ে হিসেবে ব্যবহার করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজে কাঙ্খিত স্কলারশিপ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক বাংলাদেশি শিক্ষক তাদের চাকরি হারিয়ে কেউ দেশে বা অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। নতুন সরকার আসার পর আবার মালয়েশিয়ায় গবেষণা বা উচ্চশিক্ষার পথ ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। সেখানকার ভিসা প্রসেস প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল হয়ে গেছে। আবার দক্ষিণ কোরিয়াতে পরিশ্রম করতে হয় অনেক বেশি, সে অনুপাতে স্কলারশিপের পরিমাণ থাকে তুলনামূলক অনেক কম। অনেক সময় প্রফেসরদের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে প্রাপ্তির গরমিল খুঁজে পাওয়া যায়।

বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, চীন হতে পারে সবচেয়ে উপযোগী পাথওয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দাবিদার দেশটি এখন বিদেশি ছাত্রদের জন্য অন্যতম সুবিধাবহুল দেশ। ঝামেলামুক্ত ভিসা প্রসেস, সহজ শর্ত (অ্যাডমিশন শর্ত), মধ্যম মানের ইংরেজি ভাষা দক্ষতা, ভাল মানের স্কলারশিপ, উন্নত জীবন আর সামাজিক সুরক্ষার জন্য চীন হতে পারে বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের পাথওয়ে। ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং-এ সেরা একশতে চীনের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

এখানে অনেক ভাল মানের গবেষণা হচ্ছে, আর প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে অজস্র নামকরা গবেষণাপত্র। এখানে ১০/১২টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করতে পারলে অস্ট্রেলিয়াতে দেওয়া হয় ১৮ মাসের জব খোঁজার ভিসা সুবিধা। আবার এখানে পিএইচডি ও ডিগ্রি শেষে আছে উচ্চ বেতনের চাকরি পাওয়ার সুযোগ। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এদেশের সরকারের চুক্তিমতে প্রতি বছর ১০০ ছাত্রছাত্রীকে বিভিন্ন প্রোগ্রামে স্কলারশিপ দেওয়া হয়, চীনের সরকারি শিক্ষাবৃত্তি।

এছাড়া শত শত ছাত্রছাত্রী সরাসরি অধ্যাপককে ইমেইল করে অনেক রকম স্কলারশিপ যোগাড় করতে পারেন। প্রতি বছর ডিসেম্বর/জানুয়ারি মাসে ভর্তি এবং স্কলারশিপের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। মার্চ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এপ্রিল এর মাঝামাঝি পর্যন্ত আবেদন করা যায়। রাশিয়া থেকে মিয়ানমার এবং কোরিয়া থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত চীনে প্রায় নয় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে মানসম্মত এবং উচ্চশিক্ষার সুবিধা রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা তিন শতাধিক।

চীনে রয়েছে বিচিত্র সৌন্দর্যের অপরূপ এবং সুবিশাল লীলাভূমি। উত্তর পশ্চিম দিকে যেমন রয়েছে তীব্র ঠাণ্ডা আর অপরূপ তুষারপাত, তেমনি বসন্তে চিরসবুজ অবারিত প্রান্তর আর মনমাতানো কোকিলের ডাক, আবার গরমকালে প্রচণ্ড তাপদাহে গাছের পাতা পুড়ে যাবার দৃশ্য। পৃথিবীর প্রায় সব রকম তাজা ফলমূল আর শাকসবজি পাওয়া যায় এখানে। রয়েছে আমাদের দেশের মতো পরিচিত এবং অপরিচিত হরেক রকমের সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছ। সাংহাই আর বেইজিং-এ জীবন-ধারণের খরচ অনেক বেশি হলেও অন্যান্য শহর থেকে তুলনামূলক কম।

চীনের সরকারি শিক্ষাবৃত্তির লিঙ্ক:

লেখক: পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক, ন্যানো কেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, সাংহাই জিয়াও তং ইউনিভার্সিটি, সাংহাই, চীন। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর (কেমিস্ট্রি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা। ই-মেইল: mahbub_iuchem@yahoo.com