‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারাই কথা বলেছেন মুগ্ধ হয়েছেন’

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন আয়োজিত আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে পররাষ্ট্র নীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফলতার নানা দিক তুলে ধরলেন প্রবীণ কূটনীতিক আনোয়ার উল করিম চৌধুরী।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2019, 06:51 AM
Updated : 16 August 2019, 05:10 PM

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক এই স্থায়ী প্রতিনিধি বলেছেন, বিদেশি যারাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন, তারাই মুগ্ধ হয়েছেন।

এই বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে এক সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদের বিরোধিতা করা চীনের পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশকে ওই প্রস্তাব আবার তুলতে বলার’ কথা জানিয়েছেন তিনি।     

১৫ অগাস্ট, স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এই আলোচনা সভায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।

ভারত, সার্বিয়া ও কিউবার স্থায়ী প্রতিনিধি এবং ফিলিস্তিনের স্থায়ী পর্যবেক্ষকও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাকে নিয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।

জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আনোয়ারুল করিম চৌধুরী ‘বঙ্গবন্ধু ও বহুপাক্ষিকতাবাদ’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন

জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তুলে ধরা, বহুপাক্ষিকতাবাদকে এগিয়ে নেওয়াসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে সব অবদান রাখেন তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ ধারণ করেই বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতাবাদের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে বিশ্বসভায় ভূমিকা রেখে চলেছে।”

জাতির জনকের সঙ্গে তার কর্মজীবনের নানা স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আনোয়ারুল করিম চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ অভিহিত করে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর বিশেষ একটি গুণ ছিল। তার সঙ্গে যারাই কথা বলেছেন তারাই মুগ্ধ হয়েছেন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর কর্মতৎপরতা বিস্তৃত হয় এবং যে চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদে ভিটো দিয়েছিল, সেই চীনের রাষ্ট্রদূত এক পর্যায়ে আমাকে ডেকে অনুরোধ করেছিলেন পুনরায় ইস্যুটি উত্থাপনের জন্য। সে সময় আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জাতিসংঘে দেন-দরবারে লিপ্ত ছিলাম।”   

আলোচনায় অংশ নিয়ে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের উল্লেখ করে বলেন, “১৫ অগাস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট যখন ভারতবাসী তাদের অকৃত্রিম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা জানতে পারে তখন ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে রূপ নেয়।”

বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শই এখন জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ অভিধা দিয়ে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “এটি সম্ভব হয়েছে কারণ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।”

সার্বিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিলান মিলানোভিচ্ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভিকা দাচ্চির বাণী পড়ে শোনান।

এই বাণীতে সার্বিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সাথে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ ব্রোজো টিটোর যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তা তুলে ধরেন এবং বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তি ‘বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি, আর আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতাও এটা যে, আমি তাদেরকে অনেক বেশি ভালোবাসি’ উল্লেখ করেন তিনি।

বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন

কিউবার রাষ্ট্রদূত আনা সিলভিয়া রদ্রিগেজ আবাসকাল বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিউবার অকুণ্ঠ কূটনৈতিক সমর্থনের কথা তুলে ধরেন।

নির্যাতিতের পক্ষে ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনন্য নেতৃত্ব, প্রচেষ্টা ও সাহসের কথা বলতে গিয়ে তিনি ১৯৭৩ সালে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সেই বিখ্যাত উদ্বৃতি “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তাই হিমালয় দেখার সাধ আর আমার নেই” উল্লেখ করেন।

ফিলিস্তিনের স্থায়ী প্রতিনিধি রিয়াদ এইচ মনসুর তাদের নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, “আজ ৪৪ বছর পর এই জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে, যা এই বিশ্বনেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি অনন্য উদ্যোগ।”

রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন স্বাগত বক্তব্যে জাতির পিতা জনগণের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি, গণতন্ত্র, শান্তি ও সহাবস্থানের যে আদর্শ রেখে গেছেন তা তুলে ধরেন।

জাতিসংঘ সদরদপ্তরে প্রথমবারের মতো জাতির পিতার শাহাদাৎ বার্ষিকীর এই আয়োজনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “আমরা আগামী বছর বিশ্বব্যাপী জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি। সে উপলক্ষে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি ২০২১ সালে উদযাপন করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী।”

এ সব অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান তিনি।

আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা, সোনালী এক্সচেঞ্জের প্রধান কার্যনির্বাহী জহুরুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুকিত চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক রাশেদ আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বারি, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল কাদের মিয়া, ভাইস প্রেসিডেন্ট জাফরউল্লাহ, আমেরিকা বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার, সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, জাতিসংঘের শিক্ষা বিষয়ক দূত নাঈমা খান, সমাজকর্মী ফরিদা ইয়াসমীন, কমিউনিটি নেতা এনাম, আশরাফুজ্জামান, সোলায়মান আলী, দেওয়ান বজলু ও এ কে এম ফজলুল হক উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে সকাল ৯টায় স্থায়ী মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়।

মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দেয়া বাণী পাঠ এবং ১৫ অগাস্টের শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়ার মাধ্যমে সকালের সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি শেষ হয়।

বিকেলে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে এই আলোচনা সভার শুরুতেও দেশি-বিদেশি অতিথিরা জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এরপর জাতির পিতার জীবন ও কর্ম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তুলে ধরে একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

আলোচনা সভা শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা ও গান পরিবেশন করা হয়। সবশেষে ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।

এর আগে ১৪ আগস্ট স্থানীয় এলম্হার্স্ট হাসপাতালে পচাঁত্তরের ১৫ অগাস্ট স্মরণে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুনেচ্ছা ও স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়া জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল আয়োজিত অনুষ্ঠানসহ যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দেন স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!