হেডস্যারের বেত

স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগের দিন৷ ক্লাশ টিচার বের হয়ে যাওয়া মাত্র সবাই হৈচৈ আর গল্পগুজব শুরু করে দিলাম৷ অমনি ব্লাকবোর্ডের সামনে রাখা ঘুণেধরা নড়বড়ে টেবিলের উপর ঠাস করে বেতের বাড়ির শব্দে আবার সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম৷

মাহবুব মানিক, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2019, 09:20 AM
Updated : 24 March 2019, 09:20 AM

বেতের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা গুড়ো গুড়ো ঘুণ ও ধুলোর আস্তরণ ধোঁয়ার মতো উড়তে লাগলো৷ দলা পাকানো কিছুটা ঘুণ খুলে ফাটা কংক্রিটের মেঝেতেও ছড়িয়ে পড়লো৷ ক্লাশে হেডস্যার ঢুকেছেন৷ হেডস্যার তার হাতে চিতাবাঘের চামড়ার মতো ডিজাইন করা সরু বেতের লাঠি উঁচিয়ে এসে বলে গেলেন- ‘তুরা সবাই কাইলকি বিকেল চাইট্টির সুমায় স্কুলের মাঠে উপস্থিত থাকপি৷’

আমরা বরাবরের মতই সমবেত কণ্ঠে বলে উঠলাম ‘ইয়েস স্যার’৷  তখন ‘চৌড়হাস মুকুল সংঘ প্রাইমারি স্কুলে’ ক্লাশ ফাইভে পড়ি৷ আমাদের স্কুলের প্রায় সব স্যারই কম বেশি কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন৷  আমরাও মোটামুটি কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলায় অভ্যস্ত ছিলাম৷

আমাদের হেডস্যারের নাম ছিল মুহাম্মাদ আবুবক্কর৷ তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রাগী একজন মানুষ৷ মাথাভর্তি কাঁচা-পাকা চুল ও মুখভর্তি চাপদাড়ি৷ হেডস্যারের কানের মধ্যেও ছিল অনেক চুল৷ কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই স্যারের কানের চুল মোটামুটি দেখা যেতো৷ কিছু মানুষ আছে যাদের চেহারা বলে দেয় খুব নরম, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে প্রচণ্ড রাগী৷ আবার অনেক সময় উল্টোটিও ঘটে৷

হয়তো মানুষটি চেহারায় রাগী কিন্তু ভেতরে বরফের মত ঠাণ্ডা৷ কিন্তু হেডস্যার ছিলেন চেহারাতেও রাগী আবার স্বভাবেও রাগী৷  মজার ব্যাপার হচ্ছে তাকে আমি কখনোই বেত ছাড়া দেখিনি৷ হঠাৎ একদিন তরকারির বাজারে তাকে লুঙ্গি পড়া অবস্থায় দেখেছিলাম৷ হাতে বেতের বদলে ছিল খাকি কাপড়ের তৈরি বাজারের থলি৷ তাকে দেখা মাত্রই ভূত দেখার মতো করে গলির চিপায় সটকে পড়লাম৷ ছোটবেলায় এটি ছিল আমাদের খুব সাধারণ ঘটনা৷ এখন যেমন চোর-বাটপারগুলো পথে পুলিশ দেখলে সটকে পড়ে আমাদের অবস্থা ছিল ঠিক তেমন৷

রাস্তা-ঘাটে স্কুলের স্যার দেখলে পড়িমরি করে লুকিয়ে পড়তাম৷ অথবা নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভদ্রছেলে হিসেবে উপস্থাপন করতাম৷ নত হয়ে সেলামের আগে পিছে স্যার যোগ করে লম্বা করে সেলাম ঠুকে দিতাম ‘স্যার আচ্ছালামু আলাইকুম স্যার!’৷ আমাদের সামনে স্যারদের পার্ট নেয়াও ছিল দেখার মতো৷ কখনো ‘ওয়ালায়কুম’ বলে সেলামের অর্ধেক ফেরত দিতেন বা  মুড অফ থাকলে কিছুই ফেরত দিতেন না৷ মাথা কাত করে ‘হুম’ বলে ঘাড় ঘুরিয়ে নিতেন৷

সেদিন হেডস্যার দোকানদারের সঙ্গে আলু-পটল বা কিছু একটার দাম নিয়ে দরকষাকষি করছিলেন৷ ওইদিন তরকারিওয়ালার সাহসের জন্য বাহবা দিয়েছিলাম৷ কেমন চিৎকার করে করে স্যারের সঙ্গে তর্ক করছে! কত্ত বড় সাহস! স্যারের সঙ্গে বাহাস করা! বেতের বাড়ি পশ্চাতে পড়লে বুঝতে পারতো হেডস্যার কি জিনিস! বাহাস করা তো দূরের কথা, তাকে দেখামাত্রই আলু-পটল ফেলে নির্ঘাত পালিয়ে যেতো!

সেদিন হেডস্যারকে খুব অসহায় অবস্থায় দেখেছিলাম৷ এমন তর্জন গর্জন করা একটা মানুষ সামান্য তরকারিওয়ালার গর্জনে ভীত! স্কুলে তাকে আসলে বেত হাতে দেখে এতটাই অভ্যস্ত ছিলাম যে এমনও ভাবতাম যে স্যার মনে হয় আঠা দিয়ে বেতটা হাতের সঙ্গে আটকে রেখেছেন৷ হাতে বেত নিয়েই ঘুমুতে যান৷ বেত নিয়েই গোসল, খাওয়া, টয়লেট সব করতে হয়৷

সেদিন তরকারির দোকানে তাকে বেত ছাড়া দেখে আসলে খুবই অবাক হয়েছিলাম৷ হেডস্যার সবসময় হাতে মোটা একটি রুপালি রংয়ের চেইনের ঘড়ি পড়তেন৷ ক্লাশে যেদিন তিনি হাত থেকে ঘড়িখানা খুলতেন সেদিন বুঝতাম আজ রোজ-কেয়ামত হতে চলেছে৷ ঘড়ি খোলা মানেই আজ তিনি আক্রমনাত্বক মুডে আছেন৷ সামান্য ত্রুটি পেলেই সপাং সপাং করে আড়ং ধোলাই চলতো৷ যাই হোক, পরদিন তিনি আমাদের সবাইকে স্কুলের মাঠে থাকতে বলেই পাশের ক্লাশে চলে গেলেন৷ পাশের ক্লাশের নীরবতা ভেঙ্গে তার আক্রমনাত্বক হুঙ্কার কানে ভেসে আসলো৷

আমাদের প্রাইমারি স্কুলে কোনো স্বাধীনতা বা বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ ছিল না৷ তবে স্কুলের বাউন্ডারি ঘেঁষে ছোট করে বানানো হয়েছিলো শহীদ মিনার৷ যদিও সেটি ছিল শহীদ মিনার৷ তারপরও বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে সেখানেই প্রতি বছর ফুল দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হতো৷ ২৬ মার্চ সকাল থেকে কুষ্টিয়া জেলা স্টেডিয়ামে ছিলাম৷ রৌদ্রজ্জ্বল দিনে গরমের মধ্যে আয়েশ করে দলবল বেঁধে গ্যালারিতে বসে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ দেখলাম৷ এরপর বিভিন্ন স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ করে গরমে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলাম৷

বাসায় এসে গোসল সেরে, খেয়ে, ঘুমিয়ে বিকেলে স্কুল মাঠে পৌঁছাতে গেলো দেরি হয়ে৷ ততক্ষণে দেখি ছাত্র-ছাত্রী লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে৷ পেছনের গেট দিয়ে ঢুকেই গোপনে আমার ক্লাশের ছেলে-মেয়েগুলোর অবস্থান স্ক্যান করতে থাকলাম৷ এদিকে আমি নিজেই হেডস্যারের ডিটেকটরে ধরা খেয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারিনি৷ তখনো আমাদের ক্লাশের লাইন খুঁজে পাইনি৷ আলতো করে এগুচ্ছি৷

হঠাৎ পিছ থেকে কে যেন হাতের মুঠি দিয়ে চুল খামচে ধরেছে৷ আমি হকচকিয়ে গেলাম৷ পিছন থেকে চুল টানতে টানতে দাঁত খিঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “এতক্ষণ কুথায় ছিলেন আপনি?” বুঝতে বাকি রইলোনা৷ এ দাঁত খিচুঁনি হেডস্যারের৷ তিনি এভাবেই ধোলাই দেবার সময় সম্মান দিয়ে ‘আপনি’ সম্বোধন করে থাকেন৷ ততক্ষণে আঁচও করে ফেলেছি৷ আজ আমার মান-সম্মানের ঘটি বাটি চাটি হয়ে যাবে৷

আশপাশে হৈচৈ করা ছেলেমেয়ে হৈচৈ ফেলে ধোলাই দেওয়া দেখছে৷ আমি বাঘের থাবার নিচে নাজুক হরিণ শাবকের মতো নিথর হয়ে আছি৷ আর মাঝে মাঝে তাকে নানা মিথ্যা কারণ দেখিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি৷ আমার দেরি ছিল মাত্র পাঁচ মিনিটের৷ এদিকে তিনিও সম্ভবত পণ করেছিলেন৷ আমার চুল না ছেঁড়া পর্যন্ত হাত সরাবেন না৷ যাই হোক, ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল৷ তিনি দ্রুতই হাত অবমুক্ত করে মাথার চুলে আবার হাত ঘষে শুইয়ে দিয়ে আদেশ দিলেন, “যা ওইযে ক্লাশ ফাইভের লাইন ওকেনে যাই দাঁড়া”৷

চুলের ব্যাথায় আমার চোখে তখনো পানি ঝড়ছে৷ চোখে পানির ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় সবকিছু ঝাপসা দেখছি ৷ দুই হাতের তালু দিয়ে দুই চোখ ডলতে ডলতে লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আড়চোখে স্যারকে একবার দেখেও নিলাম৷ তিনি খামচে ধরা বেতের লাঠি দিয়ে কাকে যেন সপাং করে পশ্চাৎদেশে বসিয়ে দিলেন৷ ওদিকে আর তাকাতে সাহস পেলাম না৷ তখনো চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছিলো৷ চোখের নিচে লোনতা পানি শুকিয়ে চটচটে হয়ে আছে৷ ঘোলা চোখ নিয়ে যথারীতি প্যারেড করলাম৷ জাতীয় সঙ্গীত পাঠ করলাম৷ শপথ করলাম৷ তারপর মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসলাম৷

ব্যাপারটা নিয়ে অনেক শকড ছিলাম৷ মাত্র পাঁচ মিনিট দেরির জন্য এভাবে ধোলাইয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ তারপরও ধোলাইটা বিকৃত রকমের ছিল৷ হাতে বা পশ্চাৎদেশে বেতের বাড়ি হলেও মানা যেতো৷ এতো মানুষের সামনে চুল টানাটানি করা ব্যাপারটা খুব দৃষ্টিকটু ও মান সম্মানের জন্য হানিকারক৷ স্যার তো একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে টানতে পারতেন! তার ইচ্ছা হলে সব চুল ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ির ড্রইংরুমে সাজিয়ে রাখতে পারতেন! কিন্তু এত ছেলেমেয়ের সামনেই কেন?

নিশ্চিত ছিলাম যে আগামীকাল ক্লাশে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে৷ ব্যাপারটা নিয়ে টেনশনে ছিলাম৷ এই শয়তানগুলোকে কিভাবে হ্যান্ডল করবো! ওই যুগে আমাদের মানসম্মান ছিল প্রচণ্ড মজবুত৷ স্কুলের স্যারদের শত অপমানেও মান-সম্মান তার জায়গা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হতো না৷ এই যুগের স্মার্ট ছেলেমেয়ের মতো করে ভীত হয়ে সুইসাইড করে সম্মান উদ্ধারের চেষ্টা কখনোই করতাম না৷

আমাদের স্কুলে হেডস্যার ছিলেন তুলনামূলক সবথেকে নরম স্বভাবের স্যার৷ আমরা যাকে আজরাইলের মতো ভয় পেতাম, তিনি ছিলেন গোবিন্দ স্যার৷ স্যার দেখতেও ছিলেন বেশ গোলগাল স্বাস্থ্যবান৷ গায়ের শক্তিও পালোয়ানদের মতো৷ তিনি ক্লাসে প্রথম বেঞ্চ থেকে পড়া ধরা শুরু করতেন৷ আর মোটামুটি পিছন থেকে দুই এক সারি আগে বসা আমি ততক্ষণে বিপদ-আপদ কাটানোর যাবতীয় দোয়া, আমপারা থেকে মুখস্ত করা চারটা কলেমা আর আয়ত্বের মধ্যে থাকা যত ছোট-বড় সূরা আছে সব মনে মনে পড়া শুরু করে দিতাম৷ আল্লাহ সহায় যে আমার কাছে আসার আগেই তিনি অন্য কোনো পাঠে মন দিতেন, নয়তো তার বিদায়ের ঘণ্টা বেজে যেতো৷

তবে গোবিন্দ স্যার বেতের লাঠিতে খুব একটা বিশ্বাসী ছিলেন না৷ লাঠি থাকলে ভালো নয়তো চড় থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে দিতেন৷ অনেক সময় আমাদের চুল টেনে মাথা উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম ঘোরাতেন৷ কখন কোনটা করবেন তা সবই তার মর্জির উপর নির্ভর করতো৷ তার আরো একটি বিকৃত ধরনের শাস্তি ছিল৷ দুই আঙ্গুলের মাঝে অষ্টকোনী ইকোনো বলপেন ঢুকিয়ে আঙ্গুল চেপে ধরে কলমে মোচড় দিতেন৷ প্রতি মোচড়ে জান বেরিয়ে হাতে চলে আসতো৷ মোচড় শেষ হলেই জানটা আবার শরীরের ভেতরে সেঁধিয়ে যেতো৷ সমসাময়িক সময়ে ওইটা খুব ভয়ংকর ধরনের শাস্তি ছিল৷

আমি মাঝে মধ্যেই স্কুল ফাঁকি দিতাম৷ আমার মা এবং বড় ভাইয়ের নিয়মিত ডিউটি ছিল আমাকে ধরে পাকড়াও করে স্কুলে রেখে আসা৷ একবার বড় ভাই তার দলবলসহ আমাকে পাঁজা করে তুলে নিয়ে গোবিন্দ স্যারের জিম্মায় রেখে আসলেন৷ স্যার আমাকে হাতে মারলেন না৷ ভাতেও মারলেন না৷ মারলেন আমার মান-সম্মান৷ স্যারের রুমের দরজার সামনে দুই কান ধরে একপায়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন৷

আমি মাথা নিঁচু করে আড়চোখে আশপাশে সব পর্যবেক্ষণ করছি৷ ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সবাই আসছে যাচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে৷ চা-ওয়ালা বাবলু ভাইও দেখে গেলেন৷ প্রায়দিন বিকেলে তার দোকানেই আব্বার সঙ্গে চা খেতে যাই৷ আজ হয়তো আর সে কপাল নেই৷ মান-সম্মান বলে কিছু আর রইলোনা৷ মান-সম্মান শেষ তাতে কি! কানে ধরার শাস্তিটা শেষ হলেই মান-সম্মান আবার নিজের জায়গায় আপনা আপনি চলে আসবে৷

গোবিন্দ স্যারের মতোই স্কুলে আরো একজন ভয়ংকর স্যার ছিলেন৷ আমরা বলতাম হুনুস্যার৷ প্রচণ্ড শুকনা ও মোটামুটি রকমের কালো সেই হুনুস্যারের আসল নাম ছিলো আব্দুল খালেক৷ স্যার খুব অতিমাত্রায় কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন৷ এখনো দেশে গেলে পথেঘাটে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়৷ স্যার রেগে গেলেই তোতলামি করতেন৷ আমরা আড়ালে বিষয়টা নিয়ে খুব হাসাহাসি করতাম৷ স্যারের পছন্দের জায়গা ছিল পশ্চাৎদেশ৷ হাতে মারলে স্বাক্ষী প্রমান থাকতো৷ পশ্চাৎদেশে লাঠি দিয়ে মেরে ঝলসে দিলেও কেউ টের পেতোনা৷

ক্লাশ ফোরে তিনি আমাদের ইসলাম শিক্ষা বই পড়াতেন৷ একদিন সূরা ফিল মুখস্ত করতে দিলেন৷ মোটামুটি কেউই আয়ত্ব করতে পারেনি৷ যারা পুরোপুরি আয়ত্ব করতে পারেনি তাদের খেলার মাঠে নামিয়ে দিলেন৷ সবাই একে অন্যের কান পাকড়ে মাঠে চক্কর দিতে লাগলো৷ যারা পারছে বেঁচে যাচ্ছে আর যারা পারছেনা তাদের পশ্চাৎদেশ ফাটিয়ে মাঠে পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ এক এক করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর আমি মান-সম্মান বাঁচাতে প্রাণপণ সূরাটি মুখস্ত করতে ব্যস্ত৷ আল্লাহ সহায় ছিলেন৷ আমার সারি পর্যন্ত আসতে আসতেই মোটামুটি আয়ত্ব করে নিয়েছিলাম৷ সে যাত্রায় নিজের মান-সম্মান বাঁচিয়ে নিলাম৷

স্কুল ফাঁকি দেওয়ার শেষ এপিসোডে মা ও বড় ভাইয়া মিলে এবার হুনু স্যারের হাতে তুলে দিয়ে আসলেন৷ তিনিও বেশ সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে কোনো কার্পণ্য করলেন না৷ প্রথমেই আমার দুই হাতের তালু তার সঙ্গে বিশেষ অফার হিসেবে পশ্চাৎদেশ লাল করে রোদের মধ্যে দুই হাতে দুটো আধলা ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন৷ মাথা, মুখ, গলা বেয়ে ঘাম ঝড়ছে৷ পিঠ ঘেমে সাদা স্কুলড্রেস পিঠের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছে৷ তবুও আমার শাস্তি আর শেষ হচ্ছেনা৷

হুনুস্যারের মনে কখন এট্টুসখানি দয়ামায়া উৎপন্ন হয় সেই অপেক্ষায় দুই হাতে দুইটা আধলা ইট নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে টিচার রুমের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছি৷ এদিকে মানসিক কষ্টে বুক আমার ফেটে যায়৷ সেদিন মায়ের উপর খুব রেগে ছিলাম৷ খুব চাচ্ছিলাম যেন সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে মরে যাই৷ তবে শাস্তির ব্যাপারটা নিয়ে সুইসাইড জাতীয় কিছু করার কথা মাথায় আসেনি৷ শুধু ন্যাচারাল ডেথ চেয়েছিলাম৷ যদিও এর থেকে হাজার গুন প্যারায় থেকেও মানুষ দিব্যি সুস্থ থাকে৷

তবে সেদিন আমার ছিল পৃথিবীর সব স্কুল এবং লেখাপড়া জাতীয় জিনিসটাকে ঘেন্না করার মতো একটা দিন৷ এই জীবন থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিল৷ ঘামতে ঘামতে বাসায় গিয়ে রাগের মাথায় ইকোনো বলপয়েন্ট কলম দিলাম ইলেক্ট্রিক সকেটে ঢুকিয়ে৷ ইচ্ছা ছিল শক খেয়ে মরে যাবো! কলমের মাথাটা সকেটে ঢুকিয়েই চোখ মুখ খামচে বসে রইলাম৷ কখন শরীরটা বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঝনঝন করে উঠবে৷ তবে প্রস্তুতও ছিলাম যে শরীরের ঝনঝন বা ব্যাথা খুব বেশি হলে সুইসাইডের ডিসিশান থেকে সরে আসবো৷ তবে জানা ছিলনা যে বলপয়েন্ট কলম বিদ্যুৎ কুপরিবাহী৷ সেদিনই ব্যাপারখানা জানলাম মাত্র৷ মূল্যবান শিক্ষাটাও পেলাম যে সুইসাইড করতে হলেও আসলে ন্যূনতম একটা শিক্ষা থাকা খুব জরুরি।

এই মুহূর্তে হেডস্যার, হুনুস্যার বা গোবিন্দ স্যার কেমন আছেন আমি সঠিক জানিনা৷ তাদের প্রতি সেই দিনগুলোতে কোনো রাগ বা ঘৃণা কিছুই দীর্ঘস্থায়ী ছিলনা৷ তারা আমার শিক্ষক৷ জীবনের সব পর্যায়ের সব শিক্ষকের জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা৷ এই রক্ত মাংসের শরীরের মাঝে বিদ্যা-বুদ্ধির অবদানের দাবিদার এই বৃহৎ মানুষগুলো৷

লেখক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!