স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকালে কানেকটিকাটের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (বিডিআই) এর আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব অভিমত জানান অর্থনীতিবিদরা।
‘পরবর্তী ৩০ বছরের বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা’ শীর্ষক উদ্বোধনী সমাবেশের সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি অধ্যাপক আতিউর রহমান। প্যানেলিস্ট ছিলেন জাতিসংঘে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান।
আতিউর বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পটি প্রকৃত অর্থেই চমকপ্রদ এবং এ গল্পের এখনো অনেকটা বাকি আছে। নব্বই দশকের মধ্যভাগেও যে অর্থনীতির আকার ছিলো ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, তা এখন বেড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। জনগণের উন্নয়নের প্রবল আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের উদ্ভাবনী উদ্যোগের কারণেই এমন সম্ভব হয়েছে।”
সাবেক গভর্নর আতিউর বলেন, “সরকারি-বেসরকারি সকল পক্ষকেই গৃহীত প্রকল্পগুলোর দক্ষ ও গুণমানসম্পন্ন বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, যাতে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যয়-সাশ্রয়ী হয়। এছাড়াও সামষ্টিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অন্তর্ভূক্তিমূলক রাখতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যেক্তাদের প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন ও তাদের বাজারের সাথে সংযুক্ততা বাড়াতে সকলকে ভূমিকা রাখতে হবে।
অর্থনীতিবিদ আতিউর তার দীর্ঘ গবেষণার আলোকে বলেন, “বাংলাদেশের উদ্যমী মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। জিঞ্জিরার অশিক্ষিত-অর্ধ শিক্ষিত মানুষেরা যে সব জিনিস তৈরি করছেন, সেগুলোর গুণগত মান ভালো নয়- এটি যেমন ঠিক, তেমনি তাদেরকে যদি প্রয়োজনীয় কারিগরি শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে জিঞ্জিরার সেই উদ্যমী লোকজনই বড় ধরনের সাফল্য দেখাতে পারবে। গত ৩০ বছরে যতটা অগ্রগতি হয়েছে, সেই ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতিও থাকতে হবে। মেধাবী তরুণ-তরুণীদের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম রাখতে হবে।”
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং সুশাসন হাতে হাত ধরে চলতে হয় এবং তার মধ্য দিয়েই সুন্দর সমাজ-ব্যবস্থা রচিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে উন্নয়ন অভিযাত্রায় সুশাসন এবং গণতন্ত্রকে মূল্যায়ন করতে কৃপণতা করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে বাংলাদেশে। মালয়েশিয়ার ধারা বর্তমান বিশ্বে কতটা প্রণিধানযোগ্য?”
মোস্তাফিজুর বলেন, “অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজে।”
তিনি বলেন, “ট্যাক্স দিতে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে ধনী ও বিত্তশালীরা যাতে ট্যাক্স দেন সে ব্যবস্থা বহাল করতে হবে। ট্যাক্স আদায়ের আইন কার্যকর করতে হবে যথাযথভাবে।”
নজরুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ এগোচ্ছে দীপ্ত প্রত্যয়ে। অগ্রগতির এই ধারা অব্যাহত রাখতে ৫ বছরের পরিবর্তে ৪ বছর অন্তর জাতীয় নির্বাচনের রীতি চালু করা উচিত। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। আর এসব সম্ভব হচ্ছে উন্নয়ন-অভিযাত্রায় সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ায়। বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগকে সরকার বিপুলভাবে উৎসাহিত করছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীদের সমন্বয়ে ১৯৮৮ সালে গঠিত বিডিআইয়ের উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলনে বাংলাদেশসহ কানাডা, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দেড়শ-রও বেশি পেশাজীবী অংশ নিচ্ছেন।
বিডিআই এর এই সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
বিডিআইয়ের প্রেসিডেন্ট মুনির কুদ্দুস কর্তৃক স্বাগত বক্তব্যের পর গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেন বিডিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা-প্রেসিডেন্ট এবং বোয়িং কোম্পানির জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী আশরাফ আলী।
এ সময় ‘আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’র প্রেসিডেন্ট গোলাম মাতবর তার বক্তব্যে বাংলাদেশের ২৪টি ইউনিভার্সিটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪ ইউনিভার্সিটির শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচি নিয়ে আলোকপাত করেন। আর এভাবেই বাংলাদেশ থেকে মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রে এসে বিভিন্ন সেক্টরের অভিজ্ঞতা লাভে সক্ষম হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের সেমিনারের বিষয়গুলো হলো- ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সরকার ব্যবস্থা’, ‘কর্মসংস্থান এবং মানবসম্পদ’, ‘উন্নয়নের জন্যে শিক্ষা’, ‘প্রবৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নিরাপত্তা’, ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ইস্যু’, ‘অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান উন্নয়ন’, ‘গ্রীণ সলিউশন’, ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ’, ‘বাল্য-বিবাহ’, ‘শিল্প উন্নয়ন’, ‘পরিবেশ সুরক্ষায় উদ্যোগ’, ‘সামাজিক নিরাপত্তা’, ‘জ্বালানী এবং পরিবেশগত সমস্যা’, ‘বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে আন্তর্জাতিক প্রভাব’, ‘পরিবহন সমস্যা’, ‘উন্নয়ন অর্থনীতি এবং হাউজহোল্ড ডাটা’, ‘শিক্ষার উন্নয়ন এবং উদ্ভাবন’ ইত্যাদি।
দ্বিতীয় দিনের সমাপনী সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করবেন আতিউর রহমান এবং বিষয়বস্তু হচ্ছে, ‘ঠাকুর এবং টেকসই উন্নয়ন: পারষ্পরিক সম্পর্ক’।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে পরিচিত প্রবাসীদের সংগঠন বিডিআই ১৯৯৫ সালে প্রথম সম্মেলন করেছে পেনসিলভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গে।
এবারের সম্মেলনে সহযোগী হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছে ইয়েল ইউনিভার্সিটির ম্যাকমিলন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ কাউন্সিল।
এবারের সম্মেলনে এবার বিশেষ সম্মান জানানো হবে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি সম্মেলনে উপস্থিত হতে না পারলেও ভিডিও কনফারেন্সে শুভেচ্ছা জানাবেন দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যার সমাবেশে।
‘২০১৭ সালের আজীবন সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড’ পাবেন তিনি। ২০১২ সাল এই সম্মাননা দেওয়া হয় বাংলাদেশের মানুষের জীবন-মানের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং কল্যাণে বিশেষ অবদানের জন্যে।
এবারের সম্মেলনে বিষয়ভিত্তিক সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি রেশমা হুসাম, নবেল উইমেন ইনিসিয়েটিভের শিরিন হক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সোসাইটির ব্যারিস্টার সারা হক, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির দিনা সিদ্দিকী প্রমুখ।
সেমিনারের হোস্ট বিডিআই এর প্রেসিডেন্ট মুনির কুদ্দুস, ভাইস প্রেসিডেন্ট রহিম কাজী এবং নির্বাহী সদস্য ফাইজুল ইসলামের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এসব সেমিনারের আলোকে পরবর্তীতে একটি সুপারিশমালা রচিত হবে। বাংলাদেশ সরকারের নীতি-নির্ধারকসহ আন্তর্জাতিক মহলে সেই সুপারিশ পৌঁছে দেওয়া হবে।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |