কেনিয়া বিশ্বের কাছে বিভিন্ন কারণে পরিচিত। অনেক হ্রদ, পাহাড়ে ঘেরা কেনিয়া। সাফারি পার্ক, মাসাই যোদ্ধা, অপরূপ সুন্দর সি-বিচ, সুউচ্চ পাহাড় মাউন্ট কেনিয়া, স্কুবা ডাইভিং,নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য কেনিয়া ভ্রমণ করা জীবনের একটি সুন্দর স্মৃতি হিসেবে থাকবে। উল্লেখ্য মাউন্ট কেনিয়া যা আফ্রিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ, তার নামেই কেনিয়ার নামকরণ করা হয়।
কেনিয়া বাংলাদেশিদের জন্য অন এরাইভাল ভিসা সুবিধা দেয় যা সেদেশে যাওয়ার পর ইমিগ্রেশন থেকেই নেওয়া যায়। এই ভিসা প্রাপ্তি অনেক সহজ এবং ভিসা সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে কর্মীরা অনেক আন্তরিক ।
কেনিয়ার মুদ্রার নাম শিলিং। বাংলাদেশের ১ টাকার সমান কেনিয়ার ১ শিলিং ২০ পয়সার মতো। অল্প বাজেটে সেখান থেকে ঘুরে আসা যায়। খাবার-দাবারের দামও কম। ভাত, সবজি, মাছ, মাংস কেনিয়ানদের স্বাভাবিক খাবার হলেও রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভুট্টা ভাজতে দেখা যায়। গ্রামের দিকের লোকজন দেখলাম ভূট্টার দোকানে জটলা পাকিয়ে থাকে। রাস্তায় লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রচুর কলা বিক্রি করে। আমাদের দেশে যেই রকম বাস থামলেই বাদাম বিক্রি হয় ঠিক তেমন।
কেনিয়ার মানুষ অনেক উদ্ভাবনশীল। সেটা যেমন তাদের কাজে কর্মে দেখা যায় তেমনি তরুণদের দল বেঁধে উদ্ভাবনের নেশায় পরে থাকতে দেখা যায়। আজকে আমাদের দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চিত্র দেখা যায় সেটা মূলত কেনিয়ার ‘এমপেশা’ (MPESA) মোবাইল মানির ধারণা এবং ব্যাপক সাফল্য থেকে উজ্জীবিত হয়ে নেওয়া। কেনিয়াতে শুরু না হলে হয়তো বাংলাদেশে আজ মোবাইল মানি বা ব্যাঙ্কিং এত জনপ্রিয় হতো না। বিভিন্ন কোম্পানি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাচ্ছে কেনিয়া। বলা যায় অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার অভিনব সমাধানের জায়গা হচ্ছে কেনিয়া।
কেনিয়া যাবেন আর ‘মাসাই’ মার্কেটে যাবেন না এটা কল্পনাও করা যায় না। তাহলে তো আপনার যাত্রা অপূর্ণাঙ্গই থেকে গেলো। মাসাই মার্কেটে কেনাকাটার মজাই আলাদা। এখানে বিচিত্র জিনিসের সমাহার ঘটে। বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় জিনিস তুলনামূলকভাবে কম দামে পাওয়া যায়। তবে মেয়েদের জিনিসের রকমারি জোগান। যেমন চুড়ি থেকে মাথার স্কার্ফ। বিভিন্ন মাসাই পুতুলের অসাধারণ সংগ্রহ থেকে আর্ট কালেকশন মন কেড়ে নেয়ার মত। আমার স্ত্রীর জন্য ওগুলো নিতে ভুল করলাম না। এখনো ঘরে মাসাই এর কাঠের পুতুল দেখলে কেনিয়ার কথা মনে পড়ে যায়।
কিন্তু যেই না উনার কথা শুনে দাম করতে গেছি দোকানি এইবার ওই বাঙালি ভদ্রমহিলাকে দাম বলে দেয়ার জন্য মোটামুটি বকাঝকাই শুরু করে দিলো। সাথে সাথে আশেপাশের দোকানিরাও একইভাবে ওনাকে কী যে বলতে লাগলো কিছু বুঝি নাই। তবে পরে কথা বলে যেটা বুঝলাম সেটা হচ্ছে ভদ্রমহিলা দাম বলে দেয়ার জন্যই যত বকাঝকা। যাই হোক শেষ পর্যন্ত অসাধারণ কিছু জিনিস কিনে, বাঙালি ভদ্র মহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে হোটেলে চলে আসলাম।
আগেই বলেছি কেনিয়াতে অনেক হ্রদ আছে। এরকম এক হ্রদ ‘লেক নাকুরু’ নামে পরিচিত। নাইরোবি থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরে লেক নাকুরুর অবস্থান। রাজহংসের অবাধ বিচরণক্ষেত্র হচ্ছে এই ‘লেক নাকুরু’।
এইখানেই লেক নাকুরু জাতীয় পার্কে বিচিত্র পশু-প্রাণীর আবাস্থল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ আসে এইখানে পরিদর্শন করতে। মূলত সিংহ, সাদা গন্ডার মূল আকর্ষণ হলেও রয়েছে সংখ্যা প্রজাতির পশু প্রাণী।
সিংহ দেখার জন্য প্রায় সারাদিন অপেক্ষা করার পর যখন সিংহ দেখতে পেলাম না মনটা খারাপ হয়ে গেল। শুনেছি খুব ভোর বেলা নাকি সিংহ সহজেই চোখে পড়ে। কপাল খারাপ হলে আর যা হয় আর কি! তবে হরিণের দল, জিরাফ, গন্ডারসহ অন্যান্য অসংখ্য প্রাণী দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
খোলা জিপে করে দল বেঁধে মানুষ উন্মুক্ত পার্কে পশুপাখির কাছিকাছি যেতে পারে। তবে খুব সাবধানে চলতে হয়। গাড়ি চালকরা সবাই বলা চলে প্রশিক্ষিত। প্রায় সারাদিন ঘুরেও দেখা যেন শেষ হয় না। এত সুন্দর প্রকৃতি, এত কাছ থেকে মুক্ত প্রাণী দেখার আনন্দই আলাদা। ঘুরে ঘুরে মনে হচ্ছিলো এ যেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফির জন্য শুটিং করছি! অসাধারণ সে অভিজ্ঞতা। মনে হয় বার বার যাই।
কেনিয়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখার সুযোগ হয়েছিল। নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কোমলমতি ছাত্ররা ফুটবল খেলছে। ছবিতে যে মাঠটি দেখা যাচ্ছে সেটি আসলেই অনেক ঢালু। বাচ্চারা ঢালু মাঠে যে কীভাবে খেলে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এইরকম অনেক চড়াই উৎরাই পার করেই তাদেরকে বড় হতে হয়।
এত সুন্দর দেশেও মানুষও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। একটা শপিং মলের বাইরে থেকে ছবি তুলতে গেছি, হঠাৎ একজন এসে ছবি তুলতে নিষেধ করলো। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করবো। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি, এভাবে ছবি তুলে নাকি অনেকেই বিদ্রোহীদের কাছে পাঠায় এবং তার সূত্র ধরে এ ধরনের জনবহুল জায়গায় অনেক সময় হামলা হয়। যাই হোক, ছবি না তুলে পাশেই থাকা কেএফসি থেকে বার্গার কিনে বিদায় নিলাম।
আরো কিছু স্মৃতি জমা হয়ে আছে। তাই অনেক কিছু লেখার ছিল। হয়তো ভবিষ্যতে লেখা যাবে। তবে সব চেয়ে ভালো লেগেছে কেনিয়ার মানুষের সহজ সরল জীবন, মানুষকে ভালোবাসা আর জীবন সংগ্রামে নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। আরো ভালো লেগেছে বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীদের নিরাপদ আবাসভূমি করে দেওয়ার জন্য। সিংহ দেখা হয়নি এইবার, কি হয়েছে? হাকুনামাঠাঠা (কেনিয়ানদের ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে : কোনো সমস্যা না)। তাই আরেকবার যেতে চাই কেনিয়াতে। খুব ভোরে, সূর্য উঠার আগেই সাফারি পার্কে। সিংহ যেন আমাকে দেখেই বলে কারিবু কেনিয়া (ওয়েলকাম টু কেনিয়া)।
লেখক: ভ্রমণপিপাসু, লেখক ও গবেষক
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক
ইমেইল : debashisemp@gmail.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |