লন্ডন প্রবাসী তন্দুরি শেফের গল্প

চোখে-মুখে অনেক স্বপ্ন ছিলো ঠিকই, কিন্তু এক বুক কষ্ট নিয়ে পেছনে ফেলে এসেছিলাম আমার সোনার বাংলাকে।

মহি উদ্দিন, যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2017, 06:10 AM
Updated : 12 Oct 2017, 06:10 AM

দিনটা ছিলো ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্য যাত্রা করেছিলাম সেদিন। বিমান যখন আকাশে উড়াল দিলো, মনের মধ্যে তখন হাহাকার বইতে লাগলো। আর বুঝি আমার মা-বাবার মুখ দেখা হবে না!

বিমান বাংলাদেশ যখন ঘোষণা দিলো যে আমরা ইউরোপের আকাশে, তখন আমার নিজেকে বড়ো একা মনে হলো। লন্ডনে নামার পর ইমিগ্রেশন শেষ করে আমার বড়ো ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। উনি আমার জন্য কিছু চকলেট আর কিছু পানীয় নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো খেয়ে তার বন্ধুর গাড়িতে করে ছুটে চললাম বার্মিংহামের দিকে।

সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো, গাড়িতে ওঠার পর থেকে আমার খুব অস্বস্তি লাগছিলো। কারণ কোনো ঝাকুনি নাই, হর্ন নাই। এগুলো দেখে মনে হলো ইংল্যান্ডের মানুষ এমন কেন! আমাদের দেশের গাড়িতে উঠলে কতো শব্দ শোনা যায়। এখানে এগুলো নাই, তাই ভালো লাগছিলো না।

যাই হোক, আরও তিন ঘণ্টার রাস্তা শেষ করে যখন বার্মিংহাম পৌঁছলাম, তখন রাত ১০টা বাজে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যখন ঘুমাতে গেলাম, তখন মনে হলো সিলেটের কথা। সেখানে আমি বাইক নিয়ে সারাদিন আড্ডা মারতাম, বন্ধুদের সাথে মজা করতাম!

পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আমি আর আমার ভাই গেলাম বার্মিংহাম টাউন হলে। একটা কথা বলা হয় নাই, আমার ভাইও আমার মতো একা ইংল্যান্ডে। বিকালে একটা নতুন মোবাইল কিনলাম, সাথে একটা সিম।

পরদিন সকালে খেয়াল করলাম, আমার ভাই ঘুম থেকে অনেক তাড়াতাড়ি উঠে নাস্তা তৈরি করলো আর আমাকে বললো নাস্তা করার জন্য। আমি মনে করলাম, হয়তো আমাকে নিয়ে কোথাও যাবে। কিন্তু না, উনি আমার হাতে বিশ পাউন্ড দিয়ে বললো, “আমি চলে যাচ্ছি কাজের জায়গায়, তুই থাক এখানে।”  

পরের সপ্তাহে যদি আমার ছুটি মেলে, তবে আমি আসবো তোর কাছে। অবিশ্বাস লাগছিলো সবকিছু। সারাদিন ঘর থেকে বের হই নাই। তার ওপর আবার অনেক ঠাণ্ডা। এভাবে দুই দিন যাওয়ার পর ভাইকে বললাম আমাকে একটা কাজ দেওয়ার জন্য।

পরদিন সকালে ভাই ফোন দিয়ে বললো, একটা গাড়ি আসবে ৩টার দিকে। আমি আমার কাপড় যেনো রেডি করে রাখি। যথাসময় গাড়ি এলো আর আমিও চলে গেলাম কাজের জায়গায়। ওখানে যাওয়ার পর সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে এলাম, কেমন লাগছে ইত্যাদি।

বিকাল ৫টা বাজার সাথে সাথে বাবুর্চি এসে আমাকে কাজে লেগে যেতে বললো। বলা হয় নাই, আমি কিন্তু রেস্টুরেন্টের কাজে এসেছি। সবকিছু পরিষ্কার করা, সবার কথা শোনা, ঝাড়ু দেওয়া, প্লেট ধোয়া, রাতে ডাস্টবিন পরিষ্কার করা, পেঁয়াজ-আলু ছিলে দেওয়া ইত্যাদি আমার কাজ।

মনে মনে চিন্তা করলাম, এটা কি কোনও জীবন হলো! আমরা কোনোদিন নিজের কাপড় নিজে ধুই নাই, এখন অন্যের প্লেট ধুতে হবে! তার ওপর আমার সাথে আকবর নামে একজন কাজ করেন, উনি আমাকে বললেন, “ভাই, মনে করেন আপনি কাজের মেয়ে। সবার কথা শুনতে হবে, এটা আপনার কাজ।”

রাত ১২টায় খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে গেলাম। হঠাৎ আমাকে ডাকলো জনি। জনি আমার সাথে কাজ করে। ও আমাকে বললো, “নতুন ভাই, একটু আমার রুমে আসেন।” গিয়ে দেখি ও মদ পান করছে। আমাকে বললো, “এসবের অভ্যাস আছে নাকি?” আমি বললাম, “না ভাই।”

ওইদিন রাতে জনি বললো, “ভাই আপনাকে একটা কথা বলি, আপনি এখানে কাজ করবেন না প্লিজ। কাজ করলে ওরা আপনাকে দিয়ে সবকিছু করাবে, যা আপনি সহ্য করতে পারবেন না।” ভাবলাম, মনে হয় নেশার ঘোরে বলছে।

পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হলো ডাকাডাকি, কাজের জন্য। যাওয়ার পর শেফ বললো, “তিন বস্তা পেঁয়াজ ছিলতে হবে, তাড়াতাড়ি। তারপর আলু ছিলবে।” করলাম সব কাজ। আড়াইটায় যে যার রুমে এসে একটু বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার ৫টায় কাজ।

এভাবে এক সপ্তাহ চলার পর যখন বেতন পেলাম, তখন দেখি বিশ পাউন্ড কম। লজ্জায় কিছু বললাম না। পরের সপ্তাহ সমান হলো আমার সাথে। সারাদিন কাজ করতাম আর রাতে বসে বসে কাঁদতাম। দুই সপ্তাহ পর ছুটিতে আসলাম। আমার ভাই কাজের অবস্তা আর বেতন জিজ্ঞেস করলো। সবকিছু খুলে বলার পর সে বললো, “আমাকে তুই আগে বলিস নাই কেনো। আমার সাথে কন্টাক হলো শুধু বিকালে কাজ আর বেতন হলো সপ্তাহে ১৬০ পাউন্ড।”

বড় ভাই শেফকে ফোন দিলেন আর সবকিছু জিজ্ঞেস করলেন। শেফ সবকিছুর জন্য ক্ষমা চেয়ে বললো, আর আমার সাথে এরকম করবে না। আমি যেনো কাজে যাই। আবার গেলাম, কিন্তু কিসের কী! কোনো পরিবর্তন নাই।

রোববার কাজ করে বললাম, কাল থেকে আমি আর কাজ করবো না। অনেক খারাপ ব্যবহার করলো আমার সাথে। যাই হোক, চলে আসার পর কয়েকদিন আর কাজ করলাম না। একা একা ঘুরতাম আর চিন্তা করতাম ওদের সিস্টেম দেখে। একেকটা ঘর দুই-তিনশ’ বছর আগের। কোনো রড নাই। কিন্তু এখনো ব্যবহার করছে মানুষ। আবার সারাদেশে পতিত জায়গা থাকার পরও ওরা বড় বাড়ি না বানিয়ে শুধু এলাকাভিত্তিক মানুষের বসবাসের জায়গা করে দিয়েছে।

আরও আশ্চর্য হলাম, শহরের মাঝে পার্ক করে সেখানে অনেক গাছগাছালি আর  সাথে হাঁস, মুরগি, কবুতর, বন্যপাখিসহ সবকিছুর বসবাসের উপযোগি করে রাখা হয়েছে দেখে। চিন্তা করে দেখলাম, আমাদের দেশ হলে মানুষ এগুলো শিকার করে খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যেতো। তাদের চিন্তা-ভাবনা অনেক সুন্দর।

এদেশের রাস্তাঘাট দেখে মনে হলো, আসলে গাড়ি বানানো হয়েছে তাদের জন্য। আমাদের জন্য ঘোড়ার গাড়ি অথবা গরুর গাড়ি দরকার। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর খবর আসলো নতুন কাজের। চলে গেলাম নতুন কাজে, যেখানে এখন পর্যন্ত আমি আছি। এখানে শুধুমাত্র বিকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ।

একেকটা দিন যাওয়ার পর চিন্তা করতাম, কবে আমি শেফ, মানে বাবুর্চি হবো? এখানে আসার পর জামিল, মহসিন, আক্কাস আলী নামের কিছু মানুষের সাথে পরিচিত হলাম। ওরাও আমার মতো বাংলাদেশ থেকে এসেছে। ওরা আমাকে অনেক সাহায্য করলো। দশ মাস পর আমার পদোন্নতি হলো। এখন আমি ‘তন্দুরি শেফ’।

সবচাইতে বড়ো কথা হলো, এখানে আমাদের দুশমন আমরা নিজেই। আমাদের ছেলে যারা এখানে জন্ম নিয়েছে, এরা আমাদের সাথে বর্ণবৈষম্য করে থাকে। ওরা চিন্তা করে না যে ওদের বাপ-দাদারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে আমাদের মতো। তবে ব্রিটিশরা আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে।

জীবনে সবচাইতে বড়ো জিনিস হলো নিজের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস। বৈধ রাস্তায় আসতে পারলে সব জায়গায় কাজ আছে। আর নাহলে নিজের দেশ অনেক শান্তির।

প্রায় চার বছর হয়ে গেলো দূর প্রবাসে আছি। এখনও ভালো থাকতে পারলাম না। ঈদের সময় চোখে কান্না ছাড়া কিছু থাকে না। এটাই প্রবাস...!

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!